স্টাফ রিপোর্টার
সরকারি চাকরি জীবন থেকে অবসরের আগে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো.সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানকে অস্বীকারের অভিযোগ রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রধান প্রকৌশলী শুধু অর্থ আত্মসাতই নয়, সহকর্মীদের হয়রানী, পদোন্নতির ক্ষেত্রে জালিয়াতি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্পে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে ৩৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, কমিশন বাণিজ্যে, অবৈধ সম্পদ অর্জন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।একটি প্রকল্পের দরপত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো.সাইফুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ণ ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ।
জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘পানির গুনগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় দুইটি দরপত্রে ‘স্টালিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠান অনিয়মের অভিযোগে পুনর্মূল্যায়নের দাবি তোলে। এই প্রকল্পের আইডি দুটিতে মোট ৫৭ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৮’শ টাকার কাজ। এই দাবির প্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাইরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মো.জসিম উদ্দিন ও উপ-সচিব ড. মো. বেলাল হোসেন। অভিযোগকৃত প্রকল্পের দরপত্র দুটির আইডি নম্বর হলে ৬৪৬৯২৪ ও ৬৪৭২৭৮। এর মধ্যে ৬৪৬৯২৪ আইডি হলো ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৪’শ টাকা এবং ৬৪৭২৭৮ আইডি হলো ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৪’শ টাকার।
তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, প্রধান প্রকৌশলী প্রকল্প দুটিতে গুরুতর অনিয়ম করেছেন। প্রধান প্রকৌশলীর খামখেয়ালীপনা, অসদাচরন ও অসচ্ছতার কারনে পিপিএ ২০০৬ এর ২৪ নং আইনের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়েছে। এছাড়াও পিপিআর ২০০৮ এর সংশ্লিষ্ট বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। অপরদিকে প্রকল্প পরিচালক মুন্সি হাসানুজ্জামান তদন্তে স্বীকার করেছেন প্রকল্পের সকল কার্যক্রম ডিপিএইচই প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত করা হয়েছে এবং তার নির্দেশক্রমেই সম্পন্ন হয়েছে।
তদন্ত কমিটি তাদের ৫ দফা সুপারিশের চতুর্থ দফায় সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) এর স্মারক নং ৫১৮, তারিখ-২০/০৭/২০২২ ইং বরাতে প্রধান প্রকৌশলী সহ তার কার্যালয়ের অস্বচ্ছতা, খামখেয়ালীপনার কারনে পিপিএ-২০০৬ এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধিসমুহ লংঘন হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহন করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো.সাইফুর রহমানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের দরপত্র আইডি দুটির ব্যাপারে আমার কাছে যা জানতে চেয়েছে তা আমি লিখিত দিয়ে এসেছি। এর বাইরে আমি অন্য কিছু বলতে চাই না।
এদিকে জানাগছে, ১৯৮৯ সালে সাইফুর রহমানস্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীন একটি প্রকল্পে সহকারী প্রকৌশলী পদে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে পেয়েছেন পদোন্নতি।২০০৭-০৮ অর্থবছরে তার চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হয়। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং ও বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা না দিয়েই ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সহকারী প্রকৌশলী (ক্যাডার) পদে ক্যাডারভুক্ত হন। আর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ক্যাডারভুক্ত হয়ে মাত্র তিন মাসের মাথায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর মাত্র সাত মাসের মধ্যে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান। আর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে ওই বছরের ৮ আগস্ট অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্ব পান তিনি। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান মো. সাইফুর রহমান। এভাবে পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সূত্র মতে, এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একাধিকবার প্রধান প্রকৌশলীর সংশ্লিষ্টতা পেলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তিনি সর্বদাই রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ণ ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বরাবরে আবেদন করেছেন সাইফুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবিদার মোসাঃ কানিছ ফাতেমা। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রেজিষ্ট্রি কাবিন মূলে তাদের বিয়ে হয়। তাছাড়া বিয়ের পর তাকে কামরাঙ্গীর চর এলাকায় বাসা ভাড়া করে রেখে প্রধান প্রকৌশলী নিয়মিত ভরন পোষন দিতেন বলে দাবি কানিছ ফাতেমার। এছাড়াও তাদের ঘরে তিন বছরের একটি কন্য সন্তানও রয়েছে।
বিবাহের পূর্বে প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেছিলেন ঢাকায় তাকে একটি বাড়ি করে দিবেন। তাছাড়া পেনশনে যে টাকা পাবেন তার অর্ধেক দ্বিতীয় স্ত্রী দাবিদার কানিছ ফাতেমার ব্যাংক একাউন্টে রাখবেন এবং প্রতি মাসের পেনশন ভাতার অর্ধেক যাতে নিয়মিতভাবে তিনি পায় সরকারীভাবে সেই ব্যাবস্থা করে দিবেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নির্মানাধীন বাড়ির অংশীদারিত্বও দিবেন। কিন্তু সাইফুর রহমান তার প্রথম স্ত্রী সুরাইয়া বেগমের নামে লিখে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো.সাইফুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা এ অভিযোগটি সম্পূর্ন ভূয়া। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কাজী মাওলানা আলমগীর হোসাইন মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। যদিও বিয়ের কাবিনের সংশ্লিষ্ট ভলিউমটা গায়েব করার গুঞ্জনও ভেসে বেড়াচ্ছে। আগামিকাল ২৯ ডিসেম্বর সাইফুর রহমানের অবসরে যাবার কথা রয়েছে। যদিও তিনি অতিরিক্ত এক বছর সময় বর্ধিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। সরকার তার আবেদন মঞ্জুর না করলে আগামিকালই তার শেষ কর্মস্থল। কিন্তু তিনি যে অনিয়মের বীজ বপন করে গেছেন এজন্য ভূগতে হবে জনসেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানকে।