নাশকতা- ষড়যন্ত্র নাকি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার আগুন?
মোঃ অমিত হাসানঃ
বেশ কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ধারাবাহিক ভাবে ঘটছে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। একের পর এক এধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনায় দেশ যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কে জর্জরিত। রাজধানী থেকে শুরু করে বন্দর, শিল্প এলাকা, এমনকি প্রশাসনিক স্থাপনাতেও ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়,গত ১৫ অক্টোবর মিরপুরের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম ইপিজেডে তোয়ালে ফ্যাক্টিরিতে আগুন এরপরই বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড আবার পরদিন বন্দরনগর চট্টগ্রামে একটি গুদামে আগুন। যেখানেই আগুন লেগেছে, সেখানেই একই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- এগুলো কি কাকতালীয় দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতার একটি সুসমন্বিত ধারা?
এই প্রশ্ন এখন কেবল সাধারণ নাগরিকদের নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও। কারণ, পাঁচ দিনের ব্যবধানে একাধিক কৌশলগত স্থাপনায় আগুন লাগা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যেখানে কিছু জায়গায় দাহ্য পদার্থ মজুদ, কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ সচরাচর ব্যবহৃত হয় না — তবুও আগুনের সূত্রপাত এমনভাবে হয়েছে, যেন তা নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং কৌশলগত আঘাতের ইঙ্গিত।
মূলত বিমানবন্দরের আগুনের ঘটনা থেকেই শুরু হয়েছে এই সন্দেহের সূচনা। বিমান কার্গো ভিলেজের দাহ্য পণ্যের মজুদ এলাকায় আগুন লেগে পুরো ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ হয়ে যায় প্রায় ছয় ঘণ্টার জন্য। একই দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি পণ্য রাখার গুদামেও আগুন লাগে — যেখানে রাসায়নিক ও পলিথিনজাত দ্রব্য ছিল।

এরপর পরই গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, নারায়ণগঞ্জের প্লাস্টিক গুদাম, রাজশাহীর খাদ্য গুদাম সবখানেই আগুন। এত স্বল্প সময়ে, ভৌগোলিকভাবে বিচিত্র স্থানে, একই প্রকৃতির দুর্ঘটনা একই সময়ে ঘটতে থাকা এই আগুনগুলো নিছক কাকতাল নয় বলেই মনে করছেন অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তাদের মতে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে থাকা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির একটি গোপন চেষ্টার অংশ হতে পারে এই আগুনের ধারা। কারণ প্রতিটি ঘটনার কেন্দ্রেই ছিল অর্থনৈতিক বা লজিস্টিক অবকাঠামো, যা রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ধমনীর সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে সন্দেহ যতই শক্তিশালী হোক, প্রমাণ ছাড়া কোনো ঘটনাকে নাশকতা বলা যায় না। এখানেই প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা নিয়ে। বাংলাদেশে এখনো অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় অংশ নির্ভর করে “প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ”এর ওপর, অর্থাৎ আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস ডাকতে হয়, কিন্তু আগুনের আগে প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি থাকে না। দেশের বেশিরভাগ শিল্প ও গুদাম এলাকায় নেই কার্যকর ফায়ার অ্যালার্ম, স্প্রিঙ্কলার বা তাপমাত্রা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। আরো ভয়াবহ বিষয়—বেশিরভাগ স্থানে দাহ্য ও রাসায়নিক পণ্য রাখা হয় অবৈধ বা অননুমোদিত গুদামে। ফলে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়, সেটি সহজেই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যেমনটি দেখা গেছে বিমানবন্দর, বন্দর বা শিল্প এলাকায়। অর্থাৎ, পরিকল্পিত নাশকতা হোক বা অবহেলার আগুন ফলাফল একইভাবে ধ্বংসাত্মক।
এই ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড এখন শুধু অগ্নি-নিরাপত্তার নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ যতটা দৃশ্যমান, তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তার চেয়ে বহু গুণ গভীর। বিমানবন্দর ও বন্দর—এই দুই জায়গাই দেশের অর্থনৈতিক সংবহনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে একদিন ফ্লাইট বন্ধ বা কন্টেইনার ডেলিভারি স্থগিত মানে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি। এমন সময় দেশে যদি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা সত্যি হয়, তাহলে তা হবে এক ধরনের অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ— যার লক্ষ্য সরাসরি জনগণের বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নড়বড়ে করা। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সাইবার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ইতিমধ্যে কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে বিদেশি যোগাযোগ বা স্থানীয় ষড়যন্ত্রমূলক নেটওয়ার্কের সম্ভাবনা যাচাই করছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে “নাশকতা” নিশ্চিত করেনি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুমান নয়, প্রমাণই চূড়ান্ত সত্য। কিন্তু ঘটনাগুলোর ঘনত্ব ও প্রকৃতি রাষ্ট্রকে এখনই পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বার্তা দিচ্ছে।
আগুন নিভে যায়, কিন্তু এর ছাইয়ে লুকিয়ে থাকে সত্য কখনো তা হয় অবহেলার, কখনো ষড়যন্ত্রের। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই আশঙ্কাই বাস্তব: অবহেলা যেমন বারবার বিপর্যয় ডেকে আনছে, তেমনি অদৃশ্য কোনো শক্তি হয়তো সেই অবহেলাকেই ব্যবহার করছে একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন শুধু আগুন নেভানো নয়, বরং আগুন লাগার আগেই তা শনাক্ত ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। কারণ, যখন একটির পর একটি কৌশলগত স্থানে আগুন লাগে, তখন সেটা কেবল কাঠ, কাগজ বা রাবার নয় জ্বলছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরিকের আস্থা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ববোধ। এই আগুন শুধু কার্গো বা কারখানার নয়, এটি আমাদের সতর্কতার পরীক্ষাও বটে যদি এখনই না জাগি, তাহলে হয়তো সত্যিই আগুনের লেলিহানে জ্বলবে দেশ।#