মির্জা বদরুজ্জামান টুনু, যশোর
যশোরাঞ্চলের ৪শ’ গ্রাহকের ৪ কোটি টাকাসহ দেশের বিভিন্ন শাখা থেকে গ্রাহকদের ৩শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের লোকজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ওই ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়ার পর নানা তালবাহানার এক পর্যায়ে যশোরে এক গ্রাহক মামলা করেছেন চক্রের ৩ জনের বিরুদ্ধে। এর আগে অনেক গ্রাহক জেলা প্রশাসক ও সমবায় অধিদপ্তরে কয়েক দফা অভিযোগ করেন। যশোর আদালতে করা ওই পিটিশনটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করতে ওসি কোতোয়ালিকে নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। সূত্র জানিয়েছে, আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড দেশের বিভিন্ন শাখায় গ্রাহকদের কাছ থেকে ২শ’৬০ কোটি টাকা গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রায় ১শ’ কোটি টাকার হদিস নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক বছর কয়েক আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার কোন এখতিয়ার আজিজ কো-অপারেটিভের নেই। বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বলেও বলা হয়। ওই প্রতিবেদন ফলাও করে চাউর হলে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্সের বিভিন্ন স্থানে ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করা হয়।
কিন্তু যশোর ব্রাঞ্চ তাদের কার্যক্রম আগের মতই চলমান রেখে গ্রাহকদের বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সত্য নয়। এছাড়া আজিজ কো-অপারেটিভ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করেছে এমন বুলি আওড়িয়ে সেই থেকে নুতন নতুন গ্রাহক সংগ্রহ করে চলে। এখন যশোর শাখা গ্রাহক সংখ্যা ৪শ’। এর মধ্যে বড় বড় এফডিআর রয়েছে ৩০টির মত। যশোর সিটি প্লাজার পাশে আজিজ কো-অপারটিভের যশোর শাখায় লাখে ৯শ’ টাকা করে মুনাফা দেয়ার নামে প্রহসন চলতে থাকে। যেখানে সরকারি ও প্রাইভেট ব্যাংক ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকার উপরে দিতে পারে না, সেখানে আজিজ কো-অপারেটিভ উচ্চ মুনাফার ঘোষণা দিয়ে যশোরাঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে বিশাল অংকের টাকা গ্রহণ করেছে যশোর শাখা। আর এখন এফডিআর মেয়াদ পূর্ণ হলেও গ্রাহকদের টাকা দেয়া হয়নি। আবার অন্য ভার্সনের গ্রাহকদের নয় ছয় করে বোঝানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর অনেক গ্রাহক হতাশা উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন। আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের ঢাকার মূল কর্তধার প্রতারণা মামলায় আটক হয়ে জেল পর্যন্ত খাটলেও যশোর শাখার ব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন ও প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মনিরুল আলম রুবেল নানামুখি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন গ্রাহকদের ঠকিয়ে আসছিলেন বলে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ করে আসছিলেন। গরু ছাগল এমনকি, জমি বিক্রি করে ওই ধুরন্ধরদের কথায় বিশ্বাস করে টাকা লগ্নি করলেও আজ তারা দিশেহারা।
তাদের প্রতিষ্ঠান যশোর শাখার ব্যাংক একাউন্ট মূলত এখন শূন্য। টাকা আটকা পড়ে আছে ঢাকাতে, দ্রæতই ছাড় হবে, দ্রæত অল্প সময়ের মধ্যে সমস্যা মিটে যাবে। একে একে সব গ্রাহকের টাকা পরিশোধ হবে এমন বুলি শুনতে শুনকে ক্লান্ত এক গ্রাহক ২১ সেপ্টেম্বর যশোর আদালতে পিটিশন দাখিল করেছেন। শহরের খড়কি শাহ আব্দুল করিম সড়কের রবিউল ইসলামের করা পিটিশনে আসামি করা হয়েছে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার শহরের খড়কির শাহ আব্দুল করিম সড়কের মনিরুল আলম রুবেল, তার বাবা এসএ খায়রুল আলম এবং পুলিশ লাইন এলাকার মৃত মুন্সী মতিয়ার রহমানের ছেলে আব্দুল হালিম।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, খড়কি শাহ আব্দুল করিম রোডের বাসিন্দা রবিউল ইসলামের প্রতিবেশী আসামি খায়রুল আলম ও তার ছেলে রুবেল শহরের গোহাটা রোডে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের অফিস নিয়ে এফডিআর ব্যবসা করতে থাকেন। এরপর আসামিরা রবিউল ইসলামকে তাদের অফিসে একটি এফডিআর খুলতে বলেন। তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর ২ লাখ ২০ হাজার টাকার ৫ বছর মেয়াদী এমটিডিআর খোলেন। এমটিডিআর এর মেয়াদ শেষ হলে আসামিরা টাকা ফেরত না দিয়ে ঘোরাতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানির পর আরও অনেকে এমটিডিআর করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি শালিস দরবার করে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আদালতে এ মামলা করেছেন।
এদিকে, মামলা করার খবর শুনে যশোরের খড়কী মধ্যপাড়ার রফিকুল ইসলাম নামে একজন গ্রামের কাগজকে জানান, তিনিও প্রতারণার শিকার। আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের তিনি একজন গ্রাহক, তাকে ঘোরারো হচ্ছে বছরের পর বছর। আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্সের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মনিরুল আলম রুবেলের কথায় বিশ্বাস করে কয়েক দফায় ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার এফডিআর গ্রাহক হয়েছিলেন। মূল টাকার দ্বিগুন দেয়া হবে প্রলোভনে পড়ে তিনি বাড়ি জিনিসপত্র ও গরু ছাগল এমনকি জমি বিক্রি করে টাকা রাখেন আজিজ কো-অপারেটিভে।
তিনি আরও জানান, যশোরাঞ্চলে তার মত ৪শ’ গ্রাহকের ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বর্তমান ম্যানেজার মোশাররফ ও অফিসার রুবেল। তারা নিজেরা লাভবান হয়েছেন, আর গ্রাহকদের ঠকিয়েছেন। এর আগে যশোর আর এন রোড এলাকার আবু মুসা নামে এক ব্যক্তি যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। এদিকে, আদালত রবিউল ইসলামের পিটিশনটি আমলে নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করতে ওসি কোতোয়ালিকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আজিজ কোঅপারেটিভের বর্তমান প্রেক্ষিত ও অভিযোগের ব্যাপারে দু’দফায় কথা হয় যশোর শাখার ব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন ও প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মনিরুল আলম রুবেলের সাথে। প্রথম দফায় তারা জানান, সম্পূর্ন স্বচ্ছতা ও আইন মেনে চলছে আজিজ কো-অপারেটিভের যশোর শাখা। যশোর শাখার ব্যাংক একাউন্ট মূলত এখন শূন্য। টাকা আটকা পড়ে আছে ঢাকাতে। অল্প সময়ের মধ্যে সমস্যা মিটে যাবে। যশোরের ৪শ’ মত গ্রাহক রয়েছে। তাদের চেয়ে অফিসাররা বেশি চিন্তায় আছেন। কেননা অফিসারদের টাকাও লগ্নি আছে। সারা দেশে পাবলিকের ৩শ’ কোটি টাকা আটকা থাকায় বিভিন্ন শাখা ব্যবস্থাপক মূল মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তিনি জেলও খেটেছেন। এরপর একটি সংবাদ প্রকাশের কিছুদিন পর মনিরুল আলম রুবেল ও তার বাবা এসএম খায়রুল আলম গ্রামের কাগজ দপ্তরে এসে জানান, তারা এখন আর আজিজ কোঅপারেটিভের সাথে জড়িত নন। মনিরুল ইসলাম রুবেল বলেন, তিনি স্তফা দিয়েছেন সকল দায় দায়িত্ব থেকে। তার সকল কাগজপত্র তার কাছে আছে। কিছু গ্রাহক না বুঝে তাদের উপর দোষ চাপিয়ে অভিযোগ করে চলেছে।