‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এবং ‘শিক্ষকই মানুষ গড়ার কারিগর’-উক্তি দু’টি সত্য। কিন্তু মেরুদন্ডকে সঠিক পরিচর্চা করা এবং কারিগরদেরকেও যথাযথ মূল্যায়ন করা যেন আজও সম্ভব হয়নি। সবাই মুখে আমাদেরকে আলোকিত মানুষ বললেও অন্তরে ভিন্নতা দেখা যায়। এজন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। শিক্ষকদের বেতনের টাকা নির্ধারিত জানায় অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এমনকি আত্মীয়তার বেলায় শিক্ষকদের নাম শুনলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন মাঝে মাঝে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হয় তেমনি পরীক্ষা পদ্ধিতিতেও পরিবর্তন আসে। এতে করে বিভিন্ন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। পূর্বে এসএসসি, এইচএসসি ও ¯œাতক এই পর্যায়গুলোতে পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষা পদ্ধতি ও পাশের হার বর্তমান থেকে আরো বেশি মানসম্মত এবং কঠিন ছিল। কিন্তু ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা নতুনদের চেয়ে পিছিয়ে যাই।
পাঠ্যবই, পরীক্ষা পদ্ধতি অনেক আধুনিক কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ার চেয়ে পাশের হার অনেক বেশি। এক্ষেত্রে মেধাবীরা এদেশে যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে। যেটা দেশের উন্নয়নে যেমন বড় অন্তরায় তেমনি শিক্ষিত ও মেধাবীদের নিজ দেশে ঘাটতি দেখা দেয়। পূর্বে বিএসসি শিক্ষক খুজে পাওয়াই মুশকিল ছিল। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও কাউকে পাওয়া যেত না। তখন পাশের হার ছিল খুবই নগন্য। বর্তমানে পাশের হার অনেক বেশি হলেও মনে হচ্ছে শিক্ষার্থীরা জানার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের বেলায় বিভিন্ন পরীক্ষায় সে হারে আর পাশ করে না। বিভিন্ন স্তরের বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত উত্তর লেখা পদ্ধতিটি (৩০/২৫টি) বেশি ফলপ্রসূ বলে আমি মনে করি। কারণ বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উদ্দেশ্য ব্যাহত। বিভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন কেজি, এনজিও স্কুল, ব্যক্তিগত স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা, নি¤œমাধ্যমিক, দাখিল, মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায় থাকায় আমরা বিব্রত। কারণ প্রাথমিক-মাধ্যমিককে একটি সু-শৃঙ্খল নিয়মে একই পাঠ্যক্রম ব্যবহৃত হলে সারা বাংলার সকল শ্রেণি পেশার মানুষ সমান সুযোগ পেত। মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও এবতেদায়ী ও দাখিলকে একই নিয়মে এনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মতো পরিচালিত হলে ধর্মীয় দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত। প্রাথমিকে অষ্টম সংযুক্তি, মাধ্যমিকে কলেজ, দাখিলের সাথে আলিম, ফাজিল, কামিল ও এবতেদায়ী সংযুক্ত করায় আমার মতে মূল শাখার শিক্ষা ব্যবস্থা একটু হলেও ব্যহত হয়।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং দাখিল, আলিম, ফাজিল এবং কামিল স্তরগুলো আলাদা রাখাই যথার্থ। প্রতিটি পর্যায়ের বিদ্যালয়ে আসন ব্যবস্থা নির্ধারিত হলে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছামত ছাত্র ভর্তি কিংবা বাদ দিতে পারতেন না। ফলে সকল শ্রেণি পেশার শিক্ষার্থী তথা দুর্বল ও মেধাবীরা সমানভাবে পড়াশুনা করার সুযোগ পেত। একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। অনেক দাখিল মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ বা ব্যবসায় শিক্ষা বলতে কোন শাখা নেই। তেমনি অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একই অবস্থা। আমাদের পাথরঘাটা উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৪৯টি, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী-৫টি, দাখিল মাদ্রাসা-১৮টি (এবতেদায়ী সংযুক্ত), নি¤œ মাধ্যমিক-২টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়-২৭টি। এছাড়াও ৩১টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী বেতন ভুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষমান। মাধ্যমিকের সাথে সংযুক্ত কারিগরি শাখা-৩টি, মাধ্যমিকের সাথে কলেজ সংযুক্ত-১টি। প্রতিস্তরে আলাদাভাবে বিন্যস্ত হলে আমার মতে ভালো হতো। বর্তমান সরকার বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রদান করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতুহল লক্ষ্য করা যায়। এজন্য সরকারের প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। এসএসসি পর্যায় পর্যন্ত সবার জন্য একই শিক্ষার পরিকল্পনা করা সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। দাখিল পর্যায়ে ধর্মীয় বই ঠিক রেখে কারিকুলাম একই থাকা আবশ্যক বলে মনে করি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, আইএলসি ল্যাব এগুলো মান সম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। বৃত্তি, উপ-বৃত্তি ও বিশেষ শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাময় মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ঝড়েপড়া রোধ অনেকটাই কমেছে। এগুলো চালু করার জন্য সরকারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পদ্মা সেতুর মতো যদি নিজস্ব অর্থায়নে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করা যেত তাহলে হয়তো আরো সু-শৃঙ্খল ও আকর্ষনীয়ভাবে প্রতিটি স্তরে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হতো। মাদ্রাসা থেকে সু-শিক্ষিত আলেম পেতে প্রয়োজনীয় বই সরবরাহ প্রয়োজন। কারণ সমাজকে শান্তির পথ দেখাতে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ বিষয়াবলী) পাঠ্য বইয়ের সাথে আরো বেশি সংযুক্ত করা প্রয়োজন। শিক্ষকতা পেশায় আগের তুলনায় অনেক মেধাবীদের নিয়োগ হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির দিকে। আশাকরি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও মেধাবীদের সংযুক্ত চলমান থাকলে মেরুদন্ডটিকে সঠিক পরিচর্যা করা সহজ হবে। পাশাপাশি বলবো সরকার অনেক আন্তরিক না হলে আমার মতো শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত অনেকেই বৈদেশিক প্রশিক্ষণে সুযোগ পাওয়া ছিল কল্পনার বাহিরে।
বর্তমানে বেতন বৈষম্য অনেক কমেছে, নতুন করে বিদ্যালয় জাতীয় করণ করা এবং বিদ্যালয় এমপিও ভুক্ত করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। সর্বোপরি গোল্ডেন এ+ লাভ করার ব্যর্থ ও অশুভ প্রতিযোগিতায় না নেমে বেশি করে জ্ঞান লাভ করার প্রতি আমাদের সন্তানদের যাতে মনোযোগ আকর্ষিত হয় সে বিষয় কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করছি। যাতে ভবিষ্যৎ জীবনে ভাল মানুষ হয় এবং ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। বর্তমানে একজন নিবন্ধনধারী শিক্ষক চাকুরী জীবন শুরু করেন ১২৫০০/-টাকা স্কেলে। এটা দু:খ জনক। কারণ একবার এলাকায় বসেও যদি কোন রোগের চিকিৎসা করানোর দরকার হয় তা ঐ টাকায় সংকুলান হয়না। সংসার চালানো তো পরের কথা। তাই মান সম্মত জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বেতন নির্ধারণ করবেন এ আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো আমি মাধ্যমিক শিক্ষক হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয় করণ করা সম্ভব বলে মনে করি। শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো থাকা, শিক্ষকদের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, শিক্ষকদের মর্যাদায় সরকারের উদ্যোগি হওয়া, সম্ভব হলে আইনীভাবে শিক্ষকদের জন্য যথাযথ সম্মানের জায়গা তৈরী করা, শিক্ষকদের জন্য সু-চিন্তিত ও সম্মানজনক বেতন নির্ধারণ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলোতে ও শিক্ষা কমিটিতে উচ্চ শিক্ষিত ও সুশিক্ষিত লোকদের আরো বেশি সংযুক্ত করা প্রয়োজন। শিক্ষকতার পেশায় সর্বোচ্চ মেধাবীদের সুযোগদান করা এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী করা দরকার। মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপরোক্ত সবকিছুই আবশ্যক বলে আমি মনে করি। প্রাথমিকে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী, অফিসহকারী, ধর্ম শিক্ষক আবশ্যক। শিক্ষকদের অবসর ও পেনশন কার্যক্রমটি যথাশিগ্রই পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। সর্বোপরি বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো যুগোপযোগি এবং সবচেয়ে বেশি মেধাবীদের এই পেশায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন মর্মে আমরা আশাবাদি।
মো: আবদুর রহিম
সহকারি শিক্ষক (জীব বিজ্ঞান)
পাথরঘাটা কে.এম. মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়
পাথরঘাটা, বরগুনা।
মোবা: ০১৭১৫৩৭১২৮৬
জেলা শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক-২০২২, বরগুনা।