উমর ফারুক আলহাদী
কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের সাংবাদিকতা। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যখন প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছেন, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষা যখন হুমকির মুখে তখনো কিন্ত থেমে নেই সাংবাদিকতা। আর্থিক সংকট, চাকরীর অনিশ্চয়তা, হামলা মামলা নির্যাতন হয়রানিসহ নানাবিধ সমস্যার মোকাবেলা করে সংবাদকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে। করোনা মহামারির এই সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে তারা কাজ করছেন। পেশাগত কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিবেদন তৈরী করে তা প্রকাশ ও প্রচারের কাজটি করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন তারা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন. করোনায় সারাবিশ্বের মানুষ যখন ঘরবন্দী তখন ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে ডাক্তার, নার্সদের মত ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন সাংবাদিকরা। তাদের অনেকই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গিয়েছেন। দেশে ২৬ মে বুধবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১২টি গণমাধ্যমের ১ হাজার ৩৭৬ জন কর্মী। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ১২৩ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার সাংবাদিক আছেন ১ হাজার ৪৮ জন ও ঢাকার বাইরের ৩২৮ জন। আক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৮টি সংবাদপত্র, ৩২টি টেলিভিশন চ্যানেল, ৪৫টি অনলাইন পোর্টাল, ৫টি রেডিও এবং ২টি সংবাদ সংস্থা রয়েছে। এর বাইরে আরও আক্রান্ত সংবাদকর্মী থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া আক্রান্তদের অধিকাংশের পরিবারের সদস্যরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সমস্যা মোকাবেলা করে সংবাদ কর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে। করোনা টেস্ট, রোগী শনাক্তকরণ, হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ও কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের (ভেন্টিলেটর) সংখ্যা, কিংবা, পোশাক কারখানা খোলা এবং বন্ধের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে জনমনে প্রশ্নের শেষ নেই।আর এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে বের করছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। জানা যায়. এই মহামারির মধ্যেও জনস্বার্থে দেশব্যাপী চাল চুরি, জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অসহায় দরিদ্র মানুষের খাদ্য সংকট, কর্মহীন মানুষের হাহাকার, ত্রাণ বিতরনের অনিয়ম, স্বাস্থ সুরক্ষা সামগ্রী কেনা, বিতরন, চিকিৎসা সংকট, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী এবং তা গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করার কাজ অব্যাহত রেখেছেন সংবাদকর্মীরা। এসব কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সরকারী কর্মকর্তাসহ ও বিভিন্ন মহলের রোষানলেও পড়ছেন। তারপরেও থেমে নেই সাংবাদিকতা। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য মতে, গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর এ বছরের ২০মে পর্যন্ত ৫৭ জন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এছাড়া করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১৪ জন । পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৭৯০জন। এর মধ্যে সুস্থ্য হয়েছেন এক হাজার ৭২৩ জন। করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে এক মাসে সর্বোচ্চ ৯ জন সাংবাদিক মারা যান গত বছরের জুনে। এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসে সাংবাদিক আক্রান্তের ঘটনা অনেকটা কমে আসে। ২৭ ফেব্রæয়ারি থেকে ৮ মার্চ কেউ আক্রান্ত হননি। এরপর গত ২৮ মার্চ থেকে প্রতিদিন আক্রান্ত হতে থাকেন সাংবাদিকেরা। গত ১২ এপ্রিল বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিক সমিতি তথ্য মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছে (তাঁদের ভাষায় পর্যবেক্ষণ) অনুযায়ী সাংবাদিকদের সংকটকালে টকশোতে নেতিবাচক আলোচনা না করার উপদেশ দিয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারি কালেও একাধিক এলাকায় দুর্নীতির খবর প্রকাশের জন্য সাংবাদিকেরা হুমকি দমকি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। করোনাকালের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর দশজন গবেষকের প্রকাশিত গবেষণায় এই সময়ে অন্তত দশজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার তথ্য দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়ের চেয়ে এই হয়রানির ভয় কোনো অংশেই কম নয়। সর্বশেষ প্রথম আলোর সিনিয়র প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে হয়রানি নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়ে কারাগারে যাতে হয়েছে। তবু সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে তারা কাজ করছেন। করোনা প্রতিরোধে কাজ করলেও অন্যদের মতো কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, সম্মুখসারির অনেকে প্রণোদনা পেলেও গণমাধ্যম পায়নি। গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকে নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না, চাকরি হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অন্তত চিকিৎসায় অগ্রাধিকার সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি সাংবাদিকদের। গণমাধ্যম কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি যে কত জটিল এবং গুরুতর, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। অনেকটা অত্যাবশ্যকীয় এবং জরুরি সেবা-দুর্যোগে তাঁদের ভ‚মিকা আরও বেশি। সুরক্ষা শুধু গণমাধ্যমকর্মীর নয়, তাঁর পরিবারের অন্যদেরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকেই ইতিমধ্যে এই সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, পরিবারের সদস্যরাও সংক্রমিত হয়েছেন। এছাড়া গণমাধ্যম কর্মীদের ঝুঁকি এড়াতে যে ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তা নিতে পারেনি। আবার অনেকে তা চেয়েছে কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়। অন্তত টিভির টকশোতে অতিথিদের বসার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেটুকু সতর্কতা সহজেই নেওয়া যেতে, সেটুকুও সময়মতো অনেকে নেননি। কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যেসব প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল তাও হাতে গোনা দু-একটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেকেই নেয়নি। এগুলোর জন্য কিছুটা বিনিয়োগও প্রয়োজন ছিল। যেমন সব কর্মীর যে বাসায় কাজের জন্য আলাদা ল্যাপটপ থাকবে, বা ব্রডব্যান্ডের অসীম সুবিধা অথবা প্রয়োজনীয় মোবাইল ডাটা থাকবে, এমন নয়। অফিসের নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আলাদা নিরাপত্তাকাঠামোর প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। আর, মাঠের কাজে নিয়োজিতদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাকের ব্যবস্থা করার কাজগুলো সবাই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, তাও নয়। সর্বোপরি, এঁদের অধিকাংশেরই ঝুঁকি বিমার প্রশ্নটিও একটি চিন্তার বিষয়। কিন্ত ঝুঁকি বিমার ব্যবস্থাও নেই। সংবাদকর্মীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন. করোনা থেকে বাঁচলেও গণমাধ্যমকর্মীরা জীবিকা বাঁচাতে পারবেন কিনা, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা নয়। তিনি বলেন, বিশ্বেও সব প্রান্তেই বিতরণজনিত সমস্যায় ছাপা কাগজের প্রচারে ধস নেমেছে, অনলাইনে গ্রাহক নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এমনিতেই কাগজ বিক্রির টাকায় পত্রিকার খরচ উঠত না, তাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বিজ্ঞাপন। কিন্তু, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সেই আয়ের পথও প্রায় শূন্যের কোঠায়। অনলাইনে গ্রাহক বাড়লেও আয় বাড়েনি। বাংলাদেশে স¤প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত অন্তত ৮ টি জাতীয় দৈনিকের ছাপা সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখ হয়েছে। অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। টিভি চ্যানেলগুলোও অশনিসংকেত দিয়েছে। এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, কোনো সাংবাদিক মারা গেলে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে তাঁর পরিবারকে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। আর সংবাদকর্মীর বাইরে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট অন্য কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় সুবিধা দিতে পারে সরকার। ব্যক্তিগত সচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ও সরকারের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।