শেখ কালিমউল্যাহ্ নয়ন
বন্দিদের কারাগারে প্রবেশের সময় কঠোরভাবে তল্লাশি করা হলেও নানান কৌশলে কারা কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ও মোবাইল নিয়ে ভেতরে যায় অপরাধিরা। সেই মোবাইলের মাধ্যমে কথা বলে বাইরের জগত নিয়ন্তণে রাখে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। খোজ নিয়ে জানাযায় অনৈতিক ভাবে কর্তৃপক্ষকে মেনেজ করে কারাগারে বসে এসব অপরাধীরা ফোনে কথা বলা, মাদক সেবনসহ নানান অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন আগে আদালত চত্বরে জঙ্গি ছিনতাই হওয়ার ঘটনাটাও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করেন জঙ্গিদের সাথে বাইরের লোকজনের আগেই কথোপ-কথন থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের রুপ রেখা হতেপারে।
এসব ঘটনা আগে থেকেই যোগাযোগ না করে কীভাবে সংঘটিত হয়েছে তা নিয়েও সাধারণ লোকজনের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বিষয়গুলোকে সামনে রেখে এবং দেশের প্রত্যেকটি কারাগারের পরিবেশ সুন্দর রাখাসহ নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।ইতোমধ্যে কারাগারে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য নতুন প্রদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। বন্দিরা যেন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনোভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে না পারে, সে জন্য নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করতে কারাগারের আশেপাশে ১৩০টি কম্প্রিহেনসিভ মোবাইল ফোন জ্যামার বসানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কারা অধিদফতরের একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমত জ্যামারগুলো বসানো হবে ঢাকা, কাশিমপুর-২, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি এবং নারায়ণগঞ্জের মতো দেশের বড় বড় চারটি কারাগারে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য কারাগারেও এ ব্যবস্থা চালু করা হবে। কারাগার অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন পুরাতন কারাগারকে নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে।
শত বছরের অধিক পুরনো জরাজীর্ণ এসব কারাগারে ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বন্দি গাদাগাদি করে থাকে। এই দুরবস্থা লাঘবের জন্য নতুন নতুন প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কারাগারের ভেতরে কোনও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, প্রতি মাসে কারাবন্দিরা একবার করে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। প্রতি সপ্তাহে একবার ফোনে কথা বলার সুযোগ পায়। সে সময় তথ্যের আদান-প্রদান ছাড়া অন্য কোনোভাবে যোগাযোগের সুযোগ নেই। এমন নিরাপত্তার মধ্যেও অনেকে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে সেটা খুবই সীমিত। তবে নিরাপত্তা নিয়ে কারাবন্দিরা বলছেন ২০২১ সালে এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে টানা ১১ মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারান্তরিন থাকা মো. রবিউল হাসান বলেন কারাগার হলো দেশের ভেতর আরেকটি দেশ, যেখানে টাকার বিনিময়ে অনেক কিছুই মেলে। তিনি আরো বলেন, আমি যখন কারাগারে যাই তখন করোনা ছিল। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। কারাগারে ঢোকার পর করোনার কারণে ১২ দিন আমাদেরকে একটি ভবনের নিচতলায় আলাদাভাবে রেখেছিল। সেখানে প্রচুর মশা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল। পরবর্তীতে ওখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ইনচার্র্জের সঙ্গে আমার কথা হয়। ভবনের ওপর তলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে, বিনিময়ে তাকে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা দিতে হবে। এরপর যখন মধুমতি ভবনের একটি ওয়ার্ডে নেওয়া হয় সেখানেও একই অবস্থা। পার্শ্ববর্তী ওয়ার্র্ডের আরেকজন রাইটার প্রতি মাসে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে ভালো রাখার আশ্বাস দেয়। ওঠার সময় আরও ২ হাজার। প্রথমে আমাকে ৩ হাজার টাকা দিতে বলে। কারাগারে এসব হরহামাশেই চলছে।
প্রতি সপ্তাহ একেকজনকে ১০ মিনিট ফোনে কথা বলার সুযোগ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। অথচ এর বাইরেও অর্র্থের বিনিময়ে প্রতি তিন মিনিট ১০০ টাকার বিনিময়ে কথা বলতে পারে কারাবন্দিরা। যেটা নিয়মের বাইরে গিয়ে করছে। সা¤প্রতিক সময়ে এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বেশ কিছু দিন কারাভোগ করেছেন সাব্বির আহম্মেদ (২০)। তার মতে, কারাগারে ঢোকার প্রথম দিন তাকে অনেক কষ্ট করতে হলেও পরবর্তী দিনগুলোতে আর ততটা খারাপ যায়নি। কারাগারের ভেতরের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি যে কদিন কারাগারে ছিলাম এর মধ্যে প্রথম দিন অনেক কষ্ট হয়েছে। যেটাকে আমদানি ঘর বলে প্রথম দিন সেখানে রাখা হয়েছিল। সেখানে একই ঘরে ২৫০ থেকে ৩০০ জনের মতো লোক থাকে। একজনের ওপর আরেকজন শুয়ে থাকে। একপাশ থেকে আরেক পাশে নড়াচড়ার সুযোগ নেই। সে তুলনায় যখন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে তখন ভালো ছিলাম। তিনি আরও বলেন, টাকা থাকলে কারাগারের ভেতরেও ভালো থাকা যায়। অনেক সুযোগ নেওয়া যায়। নিয়মের বাইরে কিছু কাজ হয় সেখানে। ওয়ার্র্ডের দায়িত্বে থাকেন কারাবন্দিদের মধ্যে দুই জন। একজন ইনচার্জ, অন্যজন রাইটার। তাদের কাজ ওয়ার্ড দেখাশোনা করা। অথচ এর বাইরে গিয়েও তারা কিছু কাজ করে।
নিয়ম অনুযায়ী সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখতে হয়। অথচ ইনচার্জ ও রাইটারকে টাকা দিলে তারা বিছানা গুছিয়ে রাখার সুযোগ করে দেয়। যারা টাকা দেয় কেবল তারাই সুযোগটি পায়। টাকা ছাড়া নিজের বিছানা নিজেদেরকেই গুছিয়ে রাখতে হয়। টাকার বিনিময় ছাড়া ভালো থাকার কোন সুযোগ নেই বলেও তিনি সাংবাদিকদেও এক প্রশ্নে একথা জানান। এ অভিযোগ কারাবন্দি থেকে মুক্তি পাওয়া নাহিদ, নাজমুল ও মিজানেরও। এব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরানীগঞ্জ) সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দিদের বিছানা থেকে উঠে যেতে হয়। সকালের পর বিছানা পেতে শুয়ে থাকার সুযোগ নেই। ভোর সকালে প্রত্যেক বন্দিকে গণনা করা হয়। সুতরাং নিয়মের বাইরে বিছানা পাতার সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে একজন সাধারণ বন্দি ১০ মিনিট স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। এর বাইরে গিয়েও অনেকে নানাভাবে বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন প্রশ্নের জবাবে কারাগারের এই কর্মকর্তা বলেন, বন্দিদের কারও মা-বাবা কিংবা স্ত্রী-সন্তান অসুস্থ থাকলে তখন বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের ১০মিনিটের বাইরেও ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। বন্দিদের কারাগারের ভেতরে বসে কথা বলার প্রতিটি কল আমরা মনিটরিং করি।
সাধারণ কয়েদি ছাড়া জঙ্গি কিংবা বিশেষ কোনও কয়েদির ফোনে কথা বলার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে কারা অধিদফতরের ডিআইজি প্রিজন্স (প্রশাসন) মো. মাঈন উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, কারাবন্দিরা মাঝে মধ্যে অবৈধভাবে বাইরে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করে। বাইরে ফোনে যোগাযোগ ঠেকানোর জন্য মূলত জ্যামার বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব ঠেকানোর জন্য আমরা ম্যানুয়ালি চেষ্টা করি সবসময়। তারপরও বন্দিরা কারাগারে ঢোকার সময় মাঝেমধ্যে ছোট ছোট মোবাইল পায়ুপথে, পেটের ভেতর করে, নানাভাবে কারাগারের ভেতরে নিয়ে যায়। পরে এসব ফোন দিয়ে বাইরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এসব মোবাইল কারাগারের ভেতরে নিয়ে গেলেও, যেন ব্যবহার না করতে পারে সে জন্যই জ্যামার বসানো হচ্ছে। জ্যামার এখনও কেনা হয়নি। তবে কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোথা থেকে জ্যামারগুলো কেনা হবে তা এখনও ঠিক করা হয়নি। কারাগারের অন্যান্য বিষয়গুলোও সময়ের সঙ্গে আপডেট করা হচ্ছে। কারাগারে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে, জ্যামার বসানোর পর তারা কীভাবে ফোনে কথা বলবেন? এছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কারাগারে নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কী? জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের এ কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তা বাড়ানোর পরিকল্পনা পূর্বে থেকেই করা ছিল। এছাড়া জ্যামারকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একটি ভবন কিংবা শুধু একটি বøকের মধ্যে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা যায়। কারাগার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ জন্য কোনও অসুবিধা হবে না। কারাগারে আগে যে সমস্যাগুলো ছিল তা এখন নেই। প্রতিটি সেলে বন্দিদেও জন্য পর্যাপ্ত ফ্যান রয়েছে, টেলিভিশন রয়েছে। আগের মতো এখন বন্দিদের কষ্ট করতে হয় না। পরিবেশও আগের চেয়ে অনেক ভালো। আবাসন ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
১৫০ বছর আগের পুরাতন কারাগার ভেঙে অনেক নতুন কারাগার হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এসব ৮টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। খুলনা, ময়মনসিংহ, জামালপুরে আরও কয়েকটি জেলায় অত্যাধুনিকভাবে কারাগার তৈরি করা হচ্ছে। সব কিছুই পরিকল্পনা করে করা হচ্ছে, বলে এ প্রতিবেদককে জানান কারাকর্তৃপক্ষ। কারা অধিদফতরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কারাগার থেকে যখন একজন বন্দি বের হয়ে যায় তখন সে আর কারাগারের জিম্মায় থাকে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিম্মায় চলে যায়। সে সময় তারা পুলিশের জিম্মায় থাকে। ৮০ হাজার বন্দি থেকে যদি ৮০ জন কোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেক সময় সেগুলো খুব একটা ধরা যায় না। খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবও হয় না। তল্লাশি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও নানান কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অগোচরে মাদক গ্রহণ, ভেতরে মোবাইল নিয়ে যাওয়া, বাইরের লোকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলা, কারাগারে বসে অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা, এমন অনেক অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে বন্দিরা। সা¤প্রতিক সময়ে জঙ্গি ছিনতাই হওয়া বিষয়টিও সকলের নজরে এসেছে। এসব ঘটনা আগে থেকেই যোগাযোগ না করে কীভাবে সংঘটিত হয়েছে তা নিয়েও লোকজনের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে বিষয়গুলোকে সামনে রেখে এবং দেশের প্রত্যেকটি কারাগারের পরিবেশ সুন্দর রাখাসহ নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে কারাগারে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য নতুন প্রদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। বন্দিরা যেন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনোভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে না পারে, সে জন্য নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করতে কারাগারের আশেপাশে ১৩০টি কম্প্রিহেনসিভ মোবাইল ফোন জ্যামার বসানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কারা অধিদফতরের একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমত জ্যামারগুলো বসানো হবে ঢাকা, কাশিমপুর-২, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি এবং নারায়ণগঞ্জের মতো দেশের বড় বড় চারটি কারাগারে।
পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য কারাগারেও এ ব্যবস্থা চালু করা হবে। কারাগার অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন পুরাতন কারাগারকে নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। শত বছরের অধিক পুরনো জরাজীর্ণ এসব কারাগারে ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বন্দি গাদাগাদি করে থাকে। এই দুরবস্থা লাঘবের জন্য নতুন নতুন প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কারাগারের ভেতরে কোনও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, প্রতি মাসে কারাবন্দিরা একবার করে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। প্রতি সপ্তাহে একবার ফোনে কথা বলার সুযোগ পায়। সে সময় তথ্যের আদান-প্রদান ছাড়া অন্য কোনোভাবে যোগাযোগের সুযোগ নেই। এমন নিরাপত্তার মধ্যেও অনেকে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে সেটা খুবই সীমিত শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।