আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু, কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ায় এবছর হতাশায় ভুগছেন পেঁয়াজ চাষীরা। যে আশা নিয়ে মাঠে পেঁয়াজ চাষ করেছিলো সে আশা জলে গিয়েছে। অধিকাংশ চাষীই এবছর পেঁয়াজ চাষ করে লোকসানে পড়েছে বলে অভিযোগ তাদের। অথচ কয়েকদিন ধরেই বাজারে পেঁয়াজের দর উর্ধমূখী। গত সাত দিনের ব্যবধানে কুষ্টিয়ার বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৩০ টাকা এবং এক মাসের মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে প্রায় তিনগুনে ঠেকেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ করে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে পেয়াজের দাম কেজি প্রতি ৮০টাকা হতে হবে। মালের সরবরাহও আছে, মূলত: পাইকার ও আড়তদাদের কারসাজিতেই এমন আকাশচুম্বি পেঁয়াজের দাম। খলিসাকুন্ডি বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা সলেমান খাঁজা জানান, দেশি পেঁয়াজ গত মাসে বিক্রি করেছি ২৫-৩০ টাকা কেজি। ১ সপ্তাহ আগেও দাম ছিলো ৫০-৫২ টাকা আজকে হঠাৎ করে আড়তেই পেয়াজের কেজি প্রতি ৭৫-৮০ টাকা।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া বাজারের খুচরা বিক্রেতা মওলা বিশ^াস বলেন, মাঠ থেকে পেয়াজ তোলার পর নিজের সংসারের প্রয়োজনীয় পরিমান রেখে বাকীটা পাইকারদের কাছে বিক্রী করে দিয়েছে সবাই। এখন চাষীদের কাছে পেঁয়াজ নেই। বাজারে যে পেয়াজ সরবরাহ হচ্ছে তা মূলত: দেশের বিভিন্ন আড়ত ও মজুদদারদের কাছ থেকে কিনে এনে বিক্রি করছি। এখন পেয়াজের বাজার সব বড় এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। তিনি আরো জানান, পেঁয়াজের যে খুব বেশি চাহিদা তা কিন্তু না। আমাদের এলাকায় যে পেঁয়াজ হয় তা চাষীরা তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেয় কারণ সংরক্ষণ করতে পারে না। এজন্য এখন বাইরে থেকে পেঁয়াজ আমদানী করে এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। খলিসাকুন্ডি এলাকার চাষী ইংরাজ মন্ডল জানান, এবছর আমি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। এক বিঘা জমিতে আমি ৪০ হাজার টাকা খরচ করেছি। পেঁয়াজ পেয়েছি ৬০ মন। প্রতি মন ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৩২ হাজার টাকা হয়েছে। বিঘায় আমার ৮ হাজার টাকার মতো লস হয়েছে।
মুলত চাষীরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম পায় না। ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি পেঁয়াজ আমি এখন দাম ৭০-৮০। তাহলে আমরা কিভাবে কি করবো? মিরপুর উপজেলার ক্ষুদ্র পেঁয়াজ চাষী সোহেল রানা জানান, প্রতিবছরই ৫ কাঁঠা জমিতে করে পেঁয়াজ চাষ করি। সেখান থেকে নিজেদের খাওয়া হয় এবং আত্মীস্বজনদের দেওয়া হয়। গত বছর ৫ কাঁঠা জমি থেকে আমি ৭ মন পেঁয়াজ পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার পেঁয়েছি মাত্র ১২ কেজি। একই উপজেলার পোড়াদহ এলাকার চাষী আনন্দ জানান, আমি এবছর তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করি। কিন্তু পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়নি। যেখানে ২০০মন পেঁয়াজের আশা করেছিলাম সেখানে মাত্র ৭০ মন পেঁয়াজ পেয়েছি। যাতে আমার জমির খরচই উঠিনি। কুমারখালী উপজেলার কৃষক ইন্তাজ আলী জানান, জমি, বীজ, সার, কীটনাশক, পরিচর্যা ও পরিবহন দিয়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজে খরচ হয়েছে ২৫-৩০ টাকা। কিন্তু আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে ১৫-২০ টাকায়। বড় বড় মজুতদাররা কৌশলে চাষীদের কাছ থেকে সব পেয়াজ গোডাউনে ঢুকিয়ে ইচ্ছে মতো দাম হাঁকাচ্ছে। এবার পেঁয়াজ ভালো হয়নি এই এলাকায়। অধিকাংশ চাষীই উৎপাদন খরচের তুলনায় কমদামে বিক্রী করায় লোকসান হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, কুচ্ছিার ৬টি উপজেলায় ১২ হাজার ১শ ৩১ হেক্টর জমিতে রবি মৌসুমে পেঁয়াজের চাষ হয়েছিলো।
এর মধ্যে ৩ হাজার ২শ ৮৫ হেক্টর জমিতে মুলকাটা এবং ৮ হাজার ৮শ ৪৬ হেক্টর জমিতে চারা। মুল কাটা পেঁয়াজের মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় ২ হাজার ৬শ ৯৯ হেক্টর জমিতে। এবং চারা পেঁয়াজে কুমারখালী উপজেলায় ৪ হাজার ১শ ৯১ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭শ ৩৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৬শ ৪ হেক্টর জমিতে কম আবাদ হয়েছে। তবে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে এ জেলায় ১২ হাজার ৯শ ১০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সে সময় অর্জিত হয়েছিল ১৩ হাজার ৭শ ৩৪ হেক্টর জমিতে। কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ জানান, আমরা প্রনোদনার মাধ্যমে কৃষকদের বিনামুল্যে পেঁয়াজের বীজসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করেছি। সেই সাথে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। তবে এবার তাপমাত্রার কারণে কিছু এলাকায় পেঁয়াজের ফলনে ঘাটতি হয়েছে।
তিনি আরো জানান, চাষী পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষনের ব্যবস্থা না থাকায় তারা মাঠ থেকে তুলেই বাজারে বিক্রী করায় দাম কম পায়। তবে কৃষকরা যাতে পেঁয়াজ চাষে আরো আগ্রহী হয় এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। কুষ্টিয়ার বাজার কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘হঠাৎ করে যৌক্তিক কোন কারণ ছাড়াই পেয়াজের বাজার দর অস্বাভাবিক উর্দ্ধগামীর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষনে রেখেছি। আগামী ৫/৭ দিনের মধ্যে আমাদানীকৃত পেয়াজ বাজারে ঢুকে যাবে এবং দেশীয় পেয়াজের বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে না আসলে সরকার হার্ড লাইনে যাবে বলে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে’।