সৈয়দ ফজলে রাব্বী ডলার
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ থাকায় বগুড়ায় বন্ধের পথে আড়াই শতাধিক ইটভাটা। মূলত: পরিবেশ দূষণের দায়ে অভিযুক্ত হলেও নগরায়নের ক্ষেত্রে ইটের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইটভাটা স্থাপনের সময় প্রশাসনের মনিটরিং, নজরদারি কিংবা লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে ইটভাটা স্থাপনে উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে কিনা তা যথাযথ ভাবে মনিটরিং করে না পরিবেশ অধিদপ্তর। একজন বিনিয়োগকারী যখন ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি ধার-দেনা করে আর্থিক যোগানের মাধ্যমে একটি ইটভাটা স্থাপন করে তখন নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অথচ ভাটা স্থাপনের পূর্বেই যদি এখাতে আগ্রহী বিনিয়োগকারীকে কি কি শর্ত পূরণ করলে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে এ সম্পর্কিত আগাম অবগত করা হতো, তাহলে বর্তমানে প্রশাসনিক চাপে ইটভাটা বন্ধ হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। তাই মানবিক কারণে এবং জাতীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে চলতি মৌসুমে ইটভাটা মালিকদের হয়রানী না করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সহ জেলা প্রশাসনের নিকট আকুল আবেদন জানিয়েছেন ভুক্তভোগী একাধিক ইট প্রস্তুতকারী মালিকরা। সরজমিনে বগুড়া সদর, শাজাহানপুর, গাবতলী, ধুনট এলাকায় অবস্থিত ইটভাটা সমূহ পরিদর্শন কালে ভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বগুড়ায় প্রায় ২৫০ টির মতো ইটভাটা রয়েছে এবং এই খাতে জড়িত রয়েছে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক শ্রমিক। ফলে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকা ইট প্রস্তুত ও বিপণনের উপর নির্ভরশীল। ভুক্তভোগী ইট ভাটা মালিকরা আরও জানান, পূর্বের চাইতে বর্তমানে ইটভাটায় ইট প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কয়লা, মাটি, পরিবহন খরচ সহ আনুষঙ্গিক খাতে ২/৩ গুণ বেশি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর উপর রয়েছে, ইটের মূল্য নির্ধারণে মালিকদের মাঝে অসম প্রতিযোগীতা।
ফলে ইট প্র¯‘ত এবং বিপণন করে ইট ভাটায় যারা বিনিয়োগ করেছেন বর্তমান বাস্তবতায় তারা খুব একটা স্বস্তির জায়গায় নেই। এর উপর আবার উচ্চ আদালতের নিদের্শনা মোতাবেক জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হওয়ায় চরম বিপদে রয়েছে ইটভাটা মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে জেলার একাধিক ইটভাটা মালিক জানিয়েছেন সবেমাত্র ইটভাটায় আগুন দিয়েছি এমন অবস্থায় প্রশাসনের খর্র্গহস্ত নিপতিত হওয়ায় আমরা এখন যাবো কোথায়? বগুড়া জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ২৫০ এর অধিক ইট ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে শর্ত পূরণ করেনি প্রায় ২৩৫ টি ইটভাটা। একদিকে প্রশাসন শর্ত পূরণ না করা ভাটার তালিকা প্রস্তুত করছে। অপরদিকে বগুড়া জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতি উচ্চ আদালতে রিট করা সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দেন দরবার অব্যাহত রেখেছেন। এমনতর পরিস্থিতিতে ইটভাটা মালিকদের বক্তব্য হলো লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা কোনভাবেই পূরণ করে ইটভাটা সচল রাখা সম্ভব নয়। যদিও প্রশাসন বলছে জেলায় গড়ে ওঠা বেশির ভাগ ইট ভাটার অবস্থান লোকালয়, কৃষি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক-হাসপাতাল, এমনকি এলজিইডির নির্মিত সড়কের পার্শ্বে। সরজমিনে দেখা গেছে, গাবতলীর এমজি ব্রিকস, এমএসএস ট্রেডার্স, এমবিএস ব্রিকস সড়ক সংলগ্ন কৃষি জমির পার্শ্বে অবস্থিত। অনুরূপভাবে শাজাহানপুরের সুজাবাদ এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক ইটভাটা ফসলের মাঠ ও এলজিইডি নির্মিত সড়কের পার্শ্বে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, এইসব ইট ভাটায় ২০১৮ সালের পর পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসটিআই, কলকারখানা বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস এবং জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। যদিও তারা নিয়মিত ভাবে আয়কর ও ভ্যাট ট্যাক্স প্রদান করেছেন তদুপরিও শর্ত ভঙ্গের কারণে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করা শর্তেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। ভুক্তভোগী একাধিক ইটভাটা মালিক জানিয়েছেন ২০২১ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের নবায়নের জন্য অর্থ জমা দিয়েছি। তারপরও এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাইনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইট ভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত পালন করতে হয়। এরমধ্যে রয়েছে ১২০ ফুট উচ্চতার চিমনির পরিবর্তে জিগজ্যাগ পদ্ধতির চুলা ব্যবহার, এলজিইডির নির্মিত সড়ক থেকে ৫০০ মিটার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক-হাসপাতাল এমনকি কৃষি জমি থেকে কমপক্ষে ১০০০ কিলোমিটার দূরে ইট ভাটা স্থাপন করার নিয়ম রয়েছে। একই সাথে ইট ভাটার জন্য আবাদি জমি থেকে মাটি আহরণ করা যাবে না। নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে মাটি আহরণ করা হবে তার একটি চুক্তিপত্র পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণের জন্য জমা দিতে হবে। সেই সঙ্গে মাটির ব্যবহার হ্রাসকল্পে ৫০ শতাংশ ফাপা ইট তৈরি করতে হবে। মূলত: এসব শর্ত পূরণ করলেই কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট ইট ভাটা কর্তৃপক্ষকে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র প্রদান করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন বগুড়ায় প্রায় ২৫০টি ইট ভাটা রয়েছে এর কোনোটিই এসব শর্ত পূরণ করেনি। যার ফলশ্রæতিতে নতুন করে ইট ভাটা স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান করা কিংবা পুরনো সচল ইট ভাটার লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া বিগত ২০২০ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহাতির মোহাম্মদ বলেছেন, শর্ত পূরণ না করায় একটি ইট ভাটাকেও ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। ফলে বর্তমানে জেলায় অবস্থিত সকল ইটভাটাই অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
অপরদিকে ইট ভাটা মালিকরা বলছেন যেহেতু চলতি মৌসুমে ইট ভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানো কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং পূর্বে এসংক্রান্ত আগাম কোন নির্দেশনা প্রশাসন দেয়নি তাই মানবিক এবং আর্থিক দিক বিবেচনা করে ন্যূনতম এই মৌসুমের জন্য ইট ভাটা সচল রাখার অনুমোদন দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানিয়েছে। বগুড়া জেলার ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আতিকুর রহমান বাদল বলেন, ফসলি জমির পাশে বিদ্যমান ইটভাটাগুলো সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করেছি। তাই ন্যূনতম একটি সময়সীমা দিয়ে অথবা শর্ত শিথিল করে ইটভাটা চালু রাখার অনুমতি না দিলে কোন ভাবেই ইট ভাটায় ইট প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না। এতে করে চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবরে পড়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে এই খাতে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠীর রুটি-রুজির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সীমিত সময়ের জন্য হলেও ইটভাটা সচল রাখার অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি । তিনি আরও বলেন সম্প্রতি উচ্চ আদালত কর্তৃক ইট ভাটা বন্ধে যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে উচ্চ আদালতে আমরা রিট করব।