শেখ কালিমউল্যাহ নয়ন
রাজধানীর পল্লবীতে শিশু সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিন সাহিন নামে এক যুবককে নৃশংসভাবে খুন করার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে লক্ষীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল গ্রেফতার হয়ে দির্ঘদিন কারা অন্তরিণ থাকার পর। জামিনে বেরিয়ে সন্ত্রাসীদের সাথে গোপন বৈঠক করেছেন বলে অভিযোগ নিহত শাহিনের পরিবারের, তারা বলেন প্রভাবশালী আওয়ালের এমন কর্মকান্ডে শঙ্কিত রয়েছেন পরিবার। এব্যাপাওে অচিরেই তারা আইনের দ্বারস্ত হবেন বলেও জানান সাংবাদিকদের। সূত্র জানায় সন্ত্রাসীদেও সাথে অওয়ালের কলাবাগানের নিজ অফিসে বসে সাহিনকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল। এই খুন সম্পন্ন করতে আওয়ালের সাথে ভাড়াটে খুনিদের চুক্তি হয়েছিল ত্রিশ লাখ টাকা। খুনের পর অপরাধীদের একজন আউয়ালকে ফোনে জানিয়েছিল, ‘স্যার ফিনিশড’।
বিভিন্ন তথ্য-উপত্তুর ভিত্তিতে অবশেষে আলোচিত এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে গ্রেপ্তার হন আউয়াল। দীর্ঘ উনিশ মাস কারান্তরিন থাকার পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। আউয়াল কারাগার থেকে বেরিয়ে পল্লবীতে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বৈঠক করেন , যারা সবাই সাহিন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বৈঠক শেষে তাদেও হাতে নগদ টাকাও তুলেদেন আওয়াল। এদিকে সাহিন হত্যা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে বাদী পক্ষের আপত্তিতে আদালত মামলাটি পুনরায় পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। তদন্ত সংস্থাটি বলছে, মামলার গ্রেপ্তার সব আসামি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তবে এই মামলায় দুই আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাদেরকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। আমরা তাদের গতিবিধি নজরে রেখেছি। অন্যদিকে সাহিনের মা আকলিমা বেগম বলছেন, খুনের সঙ্গে জড়িত সবাই এখন জামিনে বেরিয়ে গেছে। আউয়াল ও তার বাহিনী নতুন করে তাদেরকে হুমকি দিচ্ছে ।
বলে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছেলের (সাহিন) লাশ পেয়েছে; এবার এমনভাবে মারব বড় ছেলের (মাইনউদ্দীন) লাশ আর পাবে না। তাদের এমন হুমকিতে ভয়ে আছি। বাড়ির বাইরে বের হতে পারি না। থানায় যাব অভিযোগ দিতে সেই সাহসও পাচ্ছি না। উল্লেখ্য গতবছরের ১৬ মে বিকালে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার কথা বলে সাহিনকে পল্লবী থানার ডি বøকের একটি গ্যারেজের ভেতর নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ দৃশ্য স্থানীয় কেউ একজন মোবাইলে ধারণ করেন। প্রকাশ্য দিবালোকে লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এঘটনায় ভিকটিমের মা আকলিমা বেগম বাদি হয়ে পরদিন পল্লবী থানায় মামলা দাযের করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক তার ছেলেকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেন। এ সময় তার সাতবছরের ছেলে মাশরাফিকে মোটরসাইকেলে নিয়ে পল্লবীর ডি-বøকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে, সুমন ও টিটুসহ ১৪-১৫ জন মিলে তাকে টেনেহেঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। গ্যারেজে ঢুকিয়ে সাহিনকে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।
এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবারও এলো পাতারি ভাবে কুপিয়ে ফেলে চলে যায় এঘটনায় ঘটনাস্থলেই সাহিনের মৃত্যু হয়। আলোচিত এই হত্যাকান্ডে জড়িত মনির ও মানিক নামে দুই জন র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আর আত্মগোপনে চলে যান সাবেক এমপি এম এ আউয়াল। ঘটনার চারদিন পর কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে র্যাব আউয়ালকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, পল্লবীর সেকশন-১২ বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকার হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামে আউয়ালের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার পাশেই আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের কয়েক একর জমি জবরদখলের চেষ্টা করছে আউয়াল ও সন্ত্রাসী বাহিনী। নিজের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে ও জমি দখল করতে আউয়াল একটি বাহিনী গড়ে তোলেন, যাদেরকে প্রতিমাসে বেতন দেয় আওয়ালা। তাদেরকে দিয়েই সাহিনকে খুন করা হয় ,খুনের আগে তাদের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদক মামলা দেয় আউয়াল। এম এ আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ল²ীপুর-১ আসনে তরিকত ফেডারেশন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন তিনি। শৃঙ্খলাভঙ্গ ও নিয়মবহির্ভূত কাজ করায় ২০১৮ সালে আউয়ালকে দল থেকে বহিষ্কার করে তরিকত ফেডারেশন। এর পরের বছরই ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন।
জমির দালাল থেকে যেভাবে উত্থান আউয়ালের: রাজনৈতিক ক্ষমতা আর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপটে কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না এম এ আউয়াল। জাল-জালিয়াতি, ভ‚মি দখল ও প্রতারণায় সব সময় বেপরোয়া ছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও বেড়ে যায় বহু গুণ। বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় তার মাস্তানিও। বাড়তে থাকে দখল ও হামলা। একসময় কিছুই ছিল না যার, সেই আউয়ালের উত্থান জমির দালালি দিয়ে শুরু। এরপর দখল-জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন বিপুল অর্থের মালিক। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক এই এমপি। সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা তার নেশা হয়ে গিয়েছিল।
সাহিনের মা যা বলছেন: নিহত সাহিনের মা আকলিমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আউয়াল জামিন পাওয়ার পর সপ্তাহ খানেক আগে এলাকায় ঘুরে শো-ডাউন দিয়েছে। সঙ্গে হত্যা মামলার সব আসামিরা ছিল। শুনেছি তখন আউয়াল সবাইকে টাকা দিয়ে গেছে। এখন কী করে জানি না। নিজের আত্মীয়রাও আউয়ালের পক্ষ নিয়েছে। স্বজনরা সব আউয়ালের পক্ষে কথা বলা শুরু করেছে। সবাইকে সে ম্যানেজ করে ফেলেছে। শুনতেছি আমাদের জমি দখল করার জন্য সব ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় একটি বড় ডেভেলপার কোম্পানিকে আউয়ালের হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ দিয়ে দেবে। আর ওই বড় কোম্পানির অন্য যে জায়গা আছে সেখানে আউয়াল চলে যাবে। থানা পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আইনের কথা কী বলব। এতো তাড়াতাড়ি সব আসামি বাইরে চলে আসছে। তারা হুমকি দিচ্ছে। এ সব নিয়ে আর কত দৌড়াদৌড়ি করব। একটা ছেলে হারিয়েছি আর হারাতে চাই না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান: সাহিন হত্যা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান মনির। তিনি বলেন, ‘মামলার দুই আসামি পলাতক আছে। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। তারা দুজন গ্রেপ্তার হলেই আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারব। আর মামলায় এজাহারনামীয় দুইজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। হত্যায় জড়িত বাকিরা বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।