২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাস এমন এক অধ্যায়, যা কখনো ম্লান হবে না। এই মাস আমাদের চোখের সামনে এনে দিয়েছিল অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার ভয়ঙ্কর রূপ এবং সেইসঙ্গে প্রমাণ করেছিল ছাত্রসমাজের অদম্য সাহস আর সাধারণ মানুষের ঐক্য কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন যতটা যৌক্তিক ছিল, তার দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়ন ততটাই নির্মম। শুরুতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানাচ্ছিল—মিছিল, গণস্বাক্ষর, মানববন্ধন। কিন্তু বারবার উপেক্ষা, উদাসীনতা এবং পরোক্ষ উপহাস আন্দোলনকারীদের ক্ষোভকে ধীরে ধীরে বিক্ষোভে পরিণত করে।
যখনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও লাঠিচার্জের মতো বর্বর পন্থা শুরু হলো, তখনই এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেল। যে তরুণ-তরুণীরা একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক নিয়োগব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছিল, তারা বুঝে গেল—এই সমস্যার মূলে আছে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী প্রবণতা, জবাবদিহির অভাব এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক দুর্বৃত্তায়ন।
জুলাইয়ের প্রতিটি দিন হয়ে ওঠে এক একটি অগ্নিপরীক্ষা। শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পল্টন, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরাসহ রাজধানীর প্রতিটি সড়ক রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। ছাত্রদের বুক ঝাঁঝরা হয় পুলিশের গুলিতে। মা-বাবা যখন সন্তান হারিয়ে রাস্তায় বসে আর্তনাদ করছিলেন, তখনো প্রশাসনের টনক নড়েনি। রাষ্ট্র তখন ভেবেছিল, হয়তো ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু এই ভয়ই মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল। একের পর এক মৃত্যু, লাশের সারি, স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ—সব মিলে ক্ষোভের আগুনকে দাবানলে রূপান্তরিত করল। আর এই দাবানল শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী সকল শ্রেণির মানুষকে একই কাতারে দাঁড় করাল।
বড় এক বিপ্লবের জন্ম আমরা নিজের চোখে দেখেছি। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা, ফেসবুক লাইভ, টুইটার আর হোয়াটসঅ্যাপের চেইন মেসেজে ছড়িয়ে পড়েছে অবিচারের চিত্র। প্রশাসনের গুলিবর্ষণ আর মিথ্যা প্রচারের মুখে এই ডিজিটাল সংহতিই হয়ে উঠেছিল জনগণের প্রধান প্রতিরোধ।
এই আন্দোলন আর গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—শুধু আইন বা প্রজ্ঞাপন দিয়ে অন্যায়কে চিরস্থায়ী করা যায় না। যেখানে নাগরিকের ভোট, সম্মান, জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে কোনো সিস্টেম চিরস্থায়ী হয় না।
এই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে—ছাত্রসমাজ কেবল পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার্থী নয়, বরং এ জাতির বিবেক, অন্যায় দেখলে জেগে ওঠা বুকে অগ্নিশিখা। তাদের লড়াই শুধু তাদের জন্য নয়—সমাজের প্রতিটি শোষিত মানুষের অধিকারের জন্য।
জুলাইয়ের এই রক্তাক্ত অধ্যায় আমাদের যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে:
✅ ন্যায়বিচারের দাবিকে অগ্রাহ্য করা যায় না।
✅ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই ইতিহাসের সেরা দিকনির্দেশনা।
✅ যুবসমাজ যদি জাগে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে দিতে পারে।
✅ একবার জেগে ওঠা মানুষের মনের আগুন কোনো শক্তি দিয়ে নিভানো যায় না।
আজ, এক বছর পরও যখন সেই দিনের কথা মনে পড়ছে, তখন চোখে জল আসে—হয়তো বেদনায়, কিন্তু ততটাই গর্বে। সেই আন্দোলনের আত্মত্যাগ কেবল ব্যর্থতার হিসাব নয়। বরং এই ত্যাগ নতুন সম্ভাবনার বীজ বুনে দিয়েছে।
— মোঃ রাহাত ইসলাম, সৃজনশীল সাংবাদিক।