মোঃ মাহফিজুল ইসলাম রিপন:
দিনাজপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি’র) অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মোঃ আইনুল হক এর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক বছরে ৪ বার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য খুঁটির জোড়ে অধ্যক্ষ বহাল তবিয়তে অনিয়ম ও দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মোঃ আইনুল হক এর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ন্যায় বিচার পাবেন বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অভিযোগে জানা গেছে, গত ২৪ অক্টোবর ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০১২ পর্যন্ত কুমিল্লা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকার পর পরবর্তী প্রায় ৮ মাস কোথায় ছিলেন তা জানা যায়নি। একই ভাবে ২ এপ্রিল ২০১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি টিটিসি’তে উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকলেও এরপরে প্রায় ৮ মাস তিনি কোথায় ছিলেন তাও জানা যায়নি। গত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪ থেকে ২২ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ বছর কুড়িগ্রাম টিটিসি’তে উপাধ্যক্ষ এবং পরে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রকৌশলী মোঃ আইনুল হক কর্মরত থাকাকালীন সময়ে স্টেপ প্রকল্পসহ বিভিন্ন এনজিও কর্তৃক পরিচালনাধীন কোর্স, হাউস কিপিং কোর্স এবং জিওবি বাজেটের অধীন বিভিন্ন ক্রয় কার্যক্রম, সনদ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত হিসেবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
ঐ সময়ে তিনি নারী কেলেংকারীতেও জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, তার নিজ বাড়ী লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী এলাকায় তিনি নর্থ বেঙ্গল ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি নামে একটি বেসরকারি পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠা করেন। যার কোড নং-১৫০৯৬। বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ২টি ক্যাম্পাস রয়েছে। অভিযোগে আরো জানা গেছে, অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মোঃ আইনুল হক কুড়িগ্রাম টিটিসি’তে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের ফটোকপিয়ার মেশিনসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি তার নিজ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি পলিটেকনিকে ব্যবহার করেছেন এবং কুড়িগ্রাম টিটিসি’র প্রশিক্ষকদেরকে জোরপূর্বকভাবে তার লালমনিরহাটস্থ বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ক্লাস নিতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি রাঙ্গামাটি টিটিসি’তে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানবীর চাকমা ও মিলন চাকমাকে বেধড়ক পিটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ব্যাপারে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
অভিযোগের বরাত দিয়ে জানা যায়, দিনাজপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গত ২৩ জুলাই ২০২০ তারিখে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রকৌশলী মোঃ আইনুল হক যোগদানের পরপরই প্রতিষ্ঠানের বেসরকারী খাতের ব্যাংক হিসাব হতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ২টি চেকের মাধ্যমে নগদে ৩ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেন এবং প্রতিষ্ঠানের সরকারী খাতের ব্যাংক হিসাব হতে ছাত্র-ছাত্রীর বৃত্তি প্রদানের জন্য রক্ষিত অর্থ হতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ৬ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেছেন। পরবর্তীতে সরকারী খাতের ব্যাংক হিসাবে কয়েকবারে ৬ লক্ষ টাকা নগদে জমা প্রদান করেন, যাহা নিয়ম বর্হিভ‚ত। এ বিষয়ে হিসাবরক্ষক প্রতিবাদ করায় চীফ ইন্সট্রাক্টর গার্মেন্টস্ শাহজাহান মজুমদার বলেন, অধ্যক্ষ নিজ প্রয়োজনে ব্যাংক একাউন্ট হতে টাকা উঠাতেই পারেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বেসরকারী খাতে আয়কৃত সকল অর্থ ব্যাংক একাউন্টে জমা হওয়ার বিধান থাকলেও এক্ষেত্রে তা পালন করা হয়নি। বরঞ্চ তিনি বেসরকারি খাতে আয়ের অর্থ ব্যাংক একাউন্টে জমা না করে নিজের কাছে রেখেছেন। সেখান থেকে তিনি খেয়াল-খুশিমত খরচ করছেন। অধ্যক্ষ প্রকৌঃ মোঃ আইনুল হক অসংখ্য ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বিল উত্তোলন করেছেন। বিভিন্ন রকম ক্রয় কার্যক্রমের মাধ্যমে ভুয়া বিল ভাউচার বাজার দরের চেয়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগে আরো জানা যায়, অন্যান্য ভবন মেরামত ও সংস্কার কাজে প্রাপ্ত ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হতে পূর্ববর্তী প্রস্তাবনাকে উপেক্ষা করে (বঙ্গবন্ধু মুর্যাল-বঙ্গবন্ধু কর্তারের আধুনিকায়ন) অধ্যক্ষ নিজ খেয়াল-খুশিমত ২টি প্যাকেজের মাধ্যমে ৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৮১ টাকায় অপ্রয়োজনীয় একটি টয়লেট এবং ২ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩৭৩ টাকায় বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনের সংস্কার কাজ দেখিয়ে অর্থ খরচ করেছেন। জানা যায়, মেসার্স ঈসা কনস্ট্রাকশন, উত্তর বালুবাড়ী, টিকিয়াপাড়া উক্ত টয়লেট নির্মাণের জন্য ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩৭৩ টাকার কোটেশন প্রদান করেন।
কিন্তু টয়লেট সম্পন্ন করার জন্য মেসার্স তুরাগ এন্টারপ্রাইজ মাতাসাগরকে ৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৬১ টাকায় কাজ দেয়া হয়। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে অন্যান্য ভবন স্থাপনা ও মেরামত খাতে প্রস্তাবনা ছিল কিন্তু একাডেমিক ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধু মুর্যাল স্থাপন এবং বঙ্গবন্ধু কর্তারের আধুনিকায়ন সহ বেশ কিছু কাজ। প্রস্তাবনায় টয়লেট বা সাব-স্টেশন সংস্কারের কোন চাহিদা ছিল না। বাজেট বরাদ্দ আসার পরে অধ্যক্ষ নিজের খেয়াল-খুশিমত নতুন পরিকল্পনায় কাজ করেছেন। তদ্রæপভাবে সেইপ প্রকল্পের বিল ভাউচারে অধিকতর কম চাহিদা সম্পন্ন কোর্স (মেশন, প্লাম্বিং) এর জন্য তুলনামূলকভাবে অধিক প্রশিক্ষণ কাঁচামাল ক্রয় করা হয়েছে। পক্ষান্তরে অধিক চাহিদা সম্পন্ন কোর্সের জন্য তুলনামূলক কম টাকার প্রশিক্ষণ কাঁচামাল ক্রয় করা হয়েছে। অপরদিকে টিটিসি’র চীফ ইন্সট্রাক্টর গার্মেন্টস্ শাহজাহান মজুমদার ও লাইব্রেরিয়ান সেলিনা পারভীন দু’জনে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেয়ার জন্য ৭দিন/১৫ দিন অন্তর টিটিসি’তে এসে এক দিনে সব স্বাক্ষর করে চলে যান। এছাড়াও দিনাজপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ওয়েল্ডিং ট্রেড চালু না থাকলেও চীফ ইন্সট্রাক্টর রাশেদুল ইসলাম ঐ পদে কর্মরত থেকে অধ্যক্ষকে এসব অপকর্মে সহায়তা করে যাচ্ছে। স¤প্রতি ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত সেইপ এর অধীন পরিচালিত ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের নির্বাচন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে নির্বাচিত প্রশিক্ষনার্থীদের বেশিরভাগই পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে অধ্যায়নরত। এক্ষেত্রে অধ্যক্ষের কাছে ভর্তি পরীক্ষার ট্রেড ভিত্তিক সিলেকশনের তালিকা চাওয়া হলেও তিনি তৎক্ষণাৎ দেখাতে পারেননি। গত ৮ সেপ্টেম্বর’২১ “নিরাপদ অভিবাসন ও দক্ষতা উন্নয়ন” শীর্ষক সেমিনারে সরকারি বরাদ্দ ৩০ হাজার টাকা হলেও অধ্যক্ষ প্রকৌঃ মোঃ আইনুল হক প্রায় ২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন। অবশিষ্ট টাকার উৎস কোথায় এবং অতিরিক্ত টাকা খরচের উদ্দেশ্য কী? এ বিষয়ে অনেকে মত পোষণ করে বলেছেন, অধ্যক্ষ নিজের দুর্নীতি ও কূকীর্তি আড়াল করার জন্য এত অর্থ ব্যয়ে জাঁকজমকভাবে ঐ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ও অর্জিত সুনাম রক্ষার্থে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।