দেশ পরিবর্তন তো শুরুহলো, মানুষের পরিবর্তন কোথায়?

নানামুখী চ্যালেঞ্জ,শঙ্কা-ষড়যন্ত্রের চাপ সামলে এক মাস পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের জন্য এক মাস কোন সময় নয়। তারপরও আমরা দেখেছি এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল উপায়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জনস্বার্থকে। ইতোমধ্যেই জাতির সামনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার রোডম্যাপ দিয়েছেন। বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। আগামীর সাধারণ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। যদিও এক মাস কোনো মূল্যায়নের সময় নয়, তবে এ পর্যন্ত নেওয়া সরকারের প্রায় প্রতিটি উদ্যোগ যে সন্তোষজনক, তা বলাই বাহুল্য।

 

স্বাভাবিকভাবেই এ সরকারের প্রতি জাতির প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তা পূরণে আমাদেরও দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। আমরা আশা করব, বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যে কাজ শুরু করেছে, তা পূরণে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বীয় ক্ষেত্র থেকে সহযোগিতা করবেন। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন দেশাত্মবোধের। ভুলে গেলে চলবে না, একটি সুন্দর আগামীর জন্য যারা অকাতরে আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের সেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমাদেরই। আমরা জানি একটা দেশের সব লোক সমান হয় না, সৎও হয় না সবাই। কিন্তু একটা দেশের সরকারের অধিকাংশ লোক অসৎ এটা কীভাবে হয়! প্রশ্রয় না পেলে, সহযোগিতা না পেলে উৎসাহ না পেলে হয় না। ওপরে যদি সততা থাকে নিচের লোক ভয়ে থাকে। কিন্তু ওপর থেকে যদি অভয় দেওয়া হয়, এমনকি ভাগবাঁটোয়ারার প্রস্তাব থাকে তাহলে একজন সৎ থাকতে যাবে কেন? সত্যিই এমনটা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। অনেকে বলত, বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যেসব অকাট্য প্রমাণ সামনে আসছে বিশ্বাস না করে উপায় কী! একই দেশ আমাদের কিন্তু অবস্থার পাহাড়সমান ব্যবধান। কারও কারও হাতে কোটি কোটি টাকা। কেউ দিনে ১০০ টাকা রোজগারের জন্য সারা দিন রাস্তায় পোড়ে। ফেরি করে, মোট বয়, ইট ভাঙে। আর আমরা উন্নয়নের বড়াই করি। মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে আমাদের কত না অহংকার।

 

পত্র-পত্রিকার খবরে প্রতিদিন যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের একেকজনের দুর্নীতির ফিরিস্তি দেখে মাথা ঘুরে যায়। প্রেসার উঠে যায় চড় চড় করে। হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে এরা। হাজার কোটি টাকার নিচে কোনো কথা নেই। যাদের মহৎ ভেবে সম্মান করেছি, দেব-দেবতা মনে করেছি তাদের ঘৃণ্য কুৎসিত চেহারা যখন একের পর এক চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে আঁতকে উঠছি! মনে হচ্ছে আমি/আমরা কী করে বেঁচে আছি আজও।  সর্বোপরি আমরা দেখেছি, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া সরকার নানা প্রতিকুলতা পারকরেও তো শুরু করেছেন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। একথা তো নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি।  এতো শুরু হল কেবল সরকারের  কিংবা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে কতটুকু পরিবর্তন করতে পেরেছি এই স্বল্প সময়ে। নিজেদের দিক থেকে তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি। কই ব্যক্তিগতভাবে আমরা নিজেদেরকে তো মোটেই পাল্টাতে পেরেছি বলে মনে হয়না। বরং পাল্টায়নি আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রও। যা আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরা খবর থেকে। সুতরাং আমাদেরকে এখান থেকেই শিখতে হবে যে, একজনকে সরিয়ে অন্য একজনে বসালেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষ যেমন সরাতে হবে, একই সঙ্গে যোগ্য মানুষকে রাখতে হবে, সঠিক জায়গা দিতে হবে। পরিবর্তন আনতে হলে আগে নিজেকেও পরিবর্তীত হতে হবে।

একটা কথা আছে  যে, বদলে দাও বদলে যাও। বদলেতো দিয়েছই এবার নিজেকেও বদলাও। অর্থাৎ তুমি যদি এই পৃথিবীটাকে তোমার জন্য বদলাতে চাও, তবে তার আগে বদলাতে হবে তোমাকে নিজেকে। কারন পরিবর্তনের চাবিকাঠি নিজের কাছেই। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। অতীত থেকে বর্তমান সবসময়ই মানুষের পরিবর্তন হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। পরিবর্তনই জগতের রীতি। তবে পরিবর্তন কিন্তু একটি শিশুকে কিভাবে সংস্কার করা হচ্ছে তারই প্রতিফলন। সাতার না জানা একজন মানুষ যখন নদীতে পরে যায়,তখন সে বাঁচার জন্য সামনে যা পায়- খড়, কাঠ, বালিশ, বাঁশ ইত্যাদি যা পায় সেটাই আকড়ে ধরতে চায়। যে করেই হোক বাঁচতে হবে। ঠিক তেমনি, দরিদ্র এবং অসহায় মানুষ একটা অবলম্বন চায়। জাস্ট বেঁচে থাকার জন্য। যখন সে কোনো পথ পায় না, তখন সে মনে মনে ভাবে কেউ একজন এসে তাকে উদ্দার করবে। তার জীবন বদলে দিবে। আমাদের এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এদেশের মানুষ ঠিক তেমনই একজনকে কাছে পেয়েছেন আমাদের রাজণীতি কিংবা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ৈর অনেকগুলো কাঠামো পরিবর্তনের জন্য। সে কাজে তিনি বা তার দল হাতও দিয়েছেন যথারীতি। তাহলে আমাদের এখন কি করতে হবে ?

 

আমাদের যা পরিবর্তন করতে হবে তা হল এই পৃথিবীর সকল জিনিসগুলির প্রতি আমাদের ব্যক্তির মনোভাব। বদলাতে হবে বিশ্বের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি । আসলে কি আমরা সেটা শুরু করতে পেরেছি? আপাতত অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না।একজনকে সরিয়ে অন্য একজনে বসালেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় না। তাও আমরা হারে হারে উপলব্দি করছি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? এক স্বৈর-শাসনের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি আরেক স্বৈর-শাসকের ছোবলের ছায়া। আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর-মার আর লুট-তরাজের নৈরাজ্য। ঠিক এমনটি কিন্তু চায়নি বৈষম্য বিরোধি ছাত্র সমাজ। যেমনটি ঘটে চলছে স্বৈর-শাসনের অবসানের পর থেকে। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে আছেন, দেশে সংস্কার হবে, আমূল সংস্কার। দূর হবে দুর্নীতি। সমতা আসবে রাজণীতিতে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের এ একমাসের কর্মকান্ডে  রাষ্ট্র সংস্কারের কিছু কিছু বিষয় ফুটে উঠতে দেখলেও পরিবর্তন দেখা যায়নি দেশের মানুষের। এ নিয়ে দেশের মানুষ এখনও শঙ্কিত। পতিত সরকারের পর দেশে যে ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে তাতে করে সন্তান হারিয়ে কিংবা স্বজন হারিয়ে নতুন করে স্বাধীনতা অর্জনের সাধ তাদের বি-স্বাদেই পরিনত হচ্ছে স্বজন হারাদের।

 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানাযায়, রবিবার বগুড়ায় আদালত চত্বরে আলোচিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম হামলার শিকার হন। মারধরের শিকার হওয়ার পর সাংবাদিকদের হিরো আলম বলেন, এক স্বৈরাচারের পতনের পর আরেক দল নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে। এইটা কি স্বাধীনতা?  হামলার জন্য তিনি বিএনপিকে দায়ী করে বলেছেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের হামলার শিকার হয়েছিলাম। এবার হামলা করল বিএনপি। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির পার্থক্য কোথায়?’ এত একটি ঘটনা মাত্র। এমনি হাজারো ঘটনা ঘটেছে বিগত এই মাস খানের সময়ের ব্যবধানে। দেশের রাজণীতিতে আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি মুদ্রার উল্টা পিঠ। যা দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার বাইরের চিত্রই বটে।

 

আমরা কেবল একজন হিরো আলমের ঘটনাই নয়,কিছুদিন আগে কেরাণীগঞ্জের একটি ভিডিও ফুটেজও ভাইরাল হতে দেখেছি ঠিক একই রূপে।  সেখানে একজন ইউপি সদস্যের সাথে যা ঘটেছিল তা ছিল মানবতা লংঘনের চরম এক পরিহাস। সেখানকার শীর্ষস্থানীয় রাজণীতিবিদদের সম্মুখেই তার সাথে করা হয়েছে আদিম যুগের বর্বরতম কুৎসিত সব উপহাস। যতটুকু জানতে পেরেছি একজন নিরাপরাধ মানুষকে তারা প্রকাশ্যে করেছে চরম নির্যাতন।

 

এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে শুরু হয় নৈরাজ্য,সহিংসতা, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও বিভিন্ন জেলায় চাঁদাবাজি, লুটের মতো ঘটনা ঘটছে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে হত্যা মামলার আসামি করারও ঘটনা ঘটছে। প্রতি নিয়তই ঘটে চলছে হিংসা-প্রতিহিংসা চরিতার্থের কাজ। যে কাজ ভালো দেশ গঠনের সহায়কও নয়,না কোন ভালো মনমানষিকতার। কিন্তু  সারাদেশে চিত্রই আজ এমন। এসব কারা করছে তাও দেশবাসীর অজানা নয়। এর থেকে আমাদের সহসাই বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার সংরক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আস্থার জায়গাটি তৈরি করতে হবে মানুষের মধ্যে ।

 

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের তরুণরা এখন জেগে উঠেছে। তাদের আর দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাদের হাত ধরেই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি মানবিক দেশে পরিণত হবে। আমাদের দেখে অন্য দেশের তরুণরা শিখবে কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে হয়। মনে রাখতে হবে, মানবিক দেশ গড়ার কাজ শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। বরং ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আমাদের সবারই দায়িত্ব। সর্বত্র মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে পারলে কোথাও থাকবে না কোনো অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। আমরা গড়তে পারব শান্তি-সৌহার্দ-সম্প্রীতির মানবিক বাংলাদেশ।

 

মো.ইউসুফ আলী, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *