ইসলামের কন্ঠ
মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য মুক্তি, আত্মার প্রশান্তি, চ‚ড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতে নিরাপত্তা। কিন্তু এই মুক্তি কিসে নিহিত? কোন পথে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নবী-রাসুল ও তাঁদের উত্তরস‚রি আলেমরা। অন্য আরো অনেকের মতো ২০০ হিজরি মোতাবেক ৮১৫ খ্রি. সময়ে ইরানের আধ্যাত্মিক রাহবার ও মুসলিম মনীষী সাহল ইবনে আবদুল্লাহ তুস্তারি (রহ.) এ প্রশ্নের এক সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বব্যাপী উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুক্তি নিহিত তিনটি বিষয়ে—হালাল আহার, ফরজ আদায় এবং মহানবী (সা.)-এর অনুসরণে।
এই তিনটি উপাদান ইসলামী জীবনের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রের এমন তিনটি স্তম্ভ যেগুলোর সমন্বয়, বাস্তব অনুসরণ ও অনুকরণ মানুষকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
১. হালাল আহার : এটি আত্মার পবিত্রতার ভিত্তি। মানুষ যা খায়, তা শুধু তার দেহে প্রভাব ফেলে না, বরং তার আত্মা, চিন্তা ও আমলকেও প্রভাবিত করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু থেকে খাদ্য গ্রহণ করুন এবং সৎকাজ করুন; নিশ্চয়ই আপনারা যা করেন সে সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবগত।
’ (সুরা : আল-মুমিনুন, আয়াত : ৫১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে শরীর হারাম দিয়ে গড়া, তা একমাত্র জাহান্নামেরই উপযুক্ত।’ (সাহিহুল জামি, হাদিস : ৪৪৯৫)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, এমন শরীর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান।(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৪৪৪১)
হালাল আহার শুধু অর্থনৈতিক সততার ব্যাপার নয়, এটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার জন্যও কেন্দ্রীয় শর্ত।
একজন মানুষ যতই নামাজ, রোজা বা দান-সদকা করুক, যদি তার জীবিকা হারাম উৎস থেকে আসে, তবে তার আমলের আলো ম্লান হয়ে যায়।
আজকের পৃথিবীতে যেখানে সুদ, ঘুষ, প্রতারণা ও অন্যের হক নষ্ট করা নিত্যকার বাস্তবতা, সেখানে হালাল উপার্জন যেন এক জিহাদের নামান্তর। কিন্তু এই জিহাদই একজন মুমিনকে প্রকৃত স্বাধীনতা ও তৃপ্তি দেয়। কারণ হালাল রিজিকে আছে বরকত ও অন্তরের প্রশান্তি।
২. ফরজ আদায় : ইসলাম শুধু নৈতিক দর্শন নয়, এটি কর্মভিত্তিক জীবনবিধান।
এর ম‚ল কাঠামো গঠিত নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ ও ঈমানের ঘোষণার মতো ফরজ ইবাদতগুলোর ওপর ভর করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদতের জন্য।’ (সুরা : আজ-জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
ফরজ আদায় মানে শুধু নির্দিষ্ট কিছু রীতিনীতি পালন নয়, বরং ফরজ ইবাদত মানুষের ভেতর আল্লাহভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বীজ রোপণ করে। নামাজ শেখায় শৃঙ্খলা ও আত্মসমর্পণ, রোজা শেখায় ধৈর্য ও আত্মসংযম, জাকাত শেখায় সামাজিক দায়িত্ব, হজ শেখায় ঐক্য ও আত্মত্যাগ।
যে ব্যক্তি ফরজ ইবাদতের প্রতি অবহেলা করে, তার জীবনের বাকি অংশও শ‚ন্য হয়ে যায়। অতএব, ফরজ আদায় হলো ঈমানের প্রকাশ্য প্রতীক, যা মানুষকে অন্তর থেকেও বদলে দেয়।
৩. সুন্নতের অনুসরণ : সাহল তুস্তারি (রহ.)-এর বাণীর তৃতীয় স্তম্ভ মহানবী (সা.)-এর সুন্নতের অনুকরণ। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)
মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ মানে শুধু বাহ্যিক রীতিনীতি নয়, বরং তাঁর চরিত্র, ধৈর্য, দয়া, বিনয় ও ন্যায়ের আদর্শকে নিজের জীবনে ধারণ করা। তাঁর জীবনে ছিল সৃষ্টির প্রতি অফুরন্ত মমতা, যা শত্রুকেও বন্ধুতে পরিণত করেছিল।
আজকের যুগে মহানবী (সা.)-এর সুন্নতের অনুকরণ মানে সমাজে দয়া, সততা, ন্যায় ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা করা। নবীর আদর্শই মুমিনের জীবনের রূপরেখা, যা তাকে জাগতিক অস্থিরতার মধ্যেও আলোকিত রাখে।
মুক্তির সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি
সাহল ইবন আবদুল্লাহ (রহ.)-এর এই সংক্ষিপ্ত উক্তি আসলে ইসলামী জীবনের প‚র্ণাঙ্গ রূপরেখা। হালাল আহার আমাদের দেহ ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ইবাদতকে আল্লাহর দরবারে কবুলযোগ্য করে, ফরজ আদায় আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে, আর মহানবী (সা.)-এর সুন্নত আমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে প‚র্ণতা আনে। এই তিনটি মিলে গড়ে ওঠে মুক্তির পথ, যে পথে মানুষ আল্লাহর নিকট প্রিয়, সমাজে শ্রদ্ধেয় এবং আখিরাতে মুক্তিপ্রাপ্ত। ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে হালাল আহারকারী, ফরজ আদায়কারী এবং মহানবী (সা.)-এর অনুসারী বানিয়ে দিন।’ আমিন