বিশেষ প্রতিনিধি, পার্বত্যাঞ্চল
খাগড়াছড়ি সদরের উপজেলার গুগড়াছড়ি এলাকার রিস্নচাই মারমা দশ বছর ধরে করছেন আখ চাষ। এই আখ চাষ করে তিনি পাঁচ ছেলে-মেয়েকে ডিগ্রী পাশ করিয়েছেন। আখ চাষি রি¤্রাচাই মারমা বলেন,গুগড়াছড়ি আখ চাষের সুনাম রয়েছে সবুজ পাহাড় বেষ্টিত খাগড়াছড়িতে। তিনি জানান,এলাকায় প্রথম আখ চাষ শুরু করেছি। রং বিলাশ জাতের আখ এক একর চাষ করেছি। ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। ১ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। রং বিলাশ জাতের আখ একবার লাগালে পাঁচ বছর পর্যন্ত আখ পাওয়া যায়। লাভ বেশি, আখ চাষ করে দারুণ সংসার চলে। পাঁচ ছেলে-মেয়েকে গ্রেডি পাশ করেয়েছি। আখ চাষ করে ঘরে আলো ছড়াচ্ছে। রি¤্রাচাই মারমা আরো বলেন, এক একরে বিশ হাজার আখ হয়। স্থানীয় বাজারে আকারভেদে একটি আখ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। জায়গা পাচ্ছি না। পেলে ৬ থেকে ৮ একর আখ চাষ করার ইচ্ছে আছে।
মেশিন পাচ্ছি না, তাই গুড় তৈরি করতে পারছি না। তাঁর দেখাতে গুগড়াছড়িতে এখন পঁঞ্চাশ জনের বেশি মারমা জনগোষ্টিরা আখ চাষ করছেন। গড়াছড়ি এলাকার চাইথৈং মর্গ বলেন, ছয় বছর ধরে আখ চাষ করছি। আখ চাষ করে ছোট আকারের বাড়ি নির্মাণ করেছি। ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা করাচ্ছি। অর্থকড়ির দিক দিকে মোটামোটি সচল হয়েছি। চাইথৈং মর্গেরমত খাগড়াছড়ি জেলাতে প্রায় দুই হাজার আখ চাষ করে সংসার সচল হয়েছে। পাহাড়ে প্রতি বছর আখ চাষ বাড়ছে। কৃষি সম্প্রাসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১-২২ সালে জেলায় ২০ হাজার ৩২০ টন আখ উৎপাদিত হয়। তাঁর আগের বছর হয়েছে ২১ হাজার ৫২ টন আখ। ২০১৫-১৬ সালে উৎপাদিত হয়েছিল ১৯ হাজার ৮০০ টন। খাগড়াছড়ি সদরে সবচেয়ে বেশি আখ চাষ হয়। এরপর মহালছড়ি, দীঘিনালাসহ বিভিন্ন উপজেলাতে আখ চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। কম খরচে অধিক ফলন আখ চাষে। কৃষক লাভবান হচ্ছে অল্প পরিশ্রমে।
আখের ফলন ভালো হওয়ায় নতুন করে কৃষক আখ চাষে আগ্রহী হচ্ছে। আখের বিভিন্ন জাত রয়েছে। এর মধ্যে রং বিলাশ জাতের আখ সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। আকর্ষণীয় এবং দামেও বেশি পাওয়া যায়। তাই কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। গুগড়াছড়ি আখ চাষি অংগ্যই মর্গ বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ করছি। বছরে দুইবার আখ বিক্রি করি। গত বছর আখ বিক্রি করে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পেয়েছি। আর খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকারমত। এবার ৯০ শতক জমিতে আখ চাষ করেছি। আশা করি এবার আরো ভালো লাভ হবে। সদরের সাতভাইপাড়া এলাকার চিবিয়ে খাওয়া আখ চাষি মংরি মারমা বলেন, ২০১২ সাল থেকে আখ চাষ করে আসছি। এবার ১১০ শতক জমিতে আখ চাষ করছি। আখ চাষে তেমন রোগবালাই নেই। দশ-বার দিন পর পর আগাছা পরিস্কার করতে হয়। তাছাড়া কোন খরচ নেই। তাই আখ চাষে অনেক অনেক লাভ। কৃষি সম্প্রাসারণ কার্যালয় থেকে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলায় বর্তমানে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হচ্ছে। বছরে উৎপাদন ছাড়িয়েছে ২০ হাজার টন। বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকার আখ বেচাকেনা হয়। খেজুরবাগান কর্টিকালচার সেন্টারের উপসহকারি কর্মকর্তা সুজন চাকমা বলেন, আখ চাষ একটি অর্থকড়ি ফসল। আখ চাষ করে অনেক চাষি স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। পানছড়ি উপজেলা সড়কে দুই পাশ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় আখ চাষ হচ্ছে। স্থানীয় ভাবে গুড়ও তৈরি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সম্প্রতি আখ চাষ জোরদার প্রকল্পের পরামর্শক দিবাকর চাকমা বলেন, খাগড়াছড়ি জেলায় ৪৮০ হেক্টর আখ চাষ হচ্ছে।
আমাদের প্রকল্পে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কৃষক আখ চাষ করছে। জেলায় আখ চাষ বাড়াতে আমরা চাষিদের প্রশিক্ষণ ও চাষের সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা দিচ্ছি। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুক্তা চাকমা বলেন, ভাইবোনছড়া ও মুনিগ্রাম ১নং সদর ইউনিয়নের সবচেয়ে বেশি আখ চাষ হয়। সদরে ২৫৪ হেক্টর আখ চাষ হয়েছে। আখ দুইবার চাষ করা যায় তা আখ চাষ করার জন্য কৃষকরা আগ্রহী। কৃষকরা গুড় তৈরি করছেন। সাথী ফসল হিসেবে মিষ্টি কুমড়া, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করতে পারেন তাতে কৃষকরা লাভবান হবে। খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় আখ চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে সুগারক্রপ ইনস্টিটিউটের সহায়তায় আখের নতুন জাত চাষাবাদ করছে। এ উৎপাদিক আখ দিয়ে গবেষণা কর্তৃক আবিস্কৃত মেশিনের সাহায্যে কৃষক নিজেই গুড় তৈরি করছেন। কৃষকদের নতুন কর্মসংস্থা তৈরি হয়েছে। আখ এবং আখের গুড় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে গুড় সরবারহ করছে। ভবিষ্যৎতে এখানে আখ চাষের অপারসম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, খাগড়াছড়ি জেলাতে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার আখ বিক্রি হয়। এখানে একটি আখ চাষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।