নুরুল আলম, খাগড়াছড়ি :
পার্বত্যঅঞ্চলের খাগড়াছড়িতে আম চাষে উন্নত হচ্ছে মানুষের জীবনমান সবুজ পাহাড়ের মানুষগুলো একসময় জুম চাষের উপর নির্ভরশীল থাকলেও অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে চাষাবাদ পদ্ধতিতে এনেছেন পরিবর্তন। জুম কলা, এবং কাঁঠাল চাষে নির্ভরশীল চাষীরা বর্তমানে শুরু করেছে বাণিজ্যিক ভাবে আম চাষ। ভাল ফলন ও কৃষকদের লাভে আর্শিবাদ হয়ে আসে শংকর জাতের আম্রপালি নামের আম। একসময় পাহাড়ের হাট-বজার অন্যান্য অঞ্চলের আমের দখলে ছিলো। অনেক চড়া দামে আম কিনে খেতে হতো এখানকার অধিবাসীদের। পরবর্তীতে তৎকালীন উন্নয়ন বোর্ডের মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কৃষক পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে আম্রপালি চারা বিতরণ করা হয়।এরপর পতিত জমিতে আম চাষ করে কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন এখন আমচাষি। প্রতিবছর আম্রপালির বাম্পার ফলনে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন তারা। তাদের পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা।তারা এখন লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।এ এলাকার কৃষকদের পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে আম চাষ এখন রোল মডেলে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে খাগড়াছড়ির আমের চাহিদা ও সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে।প্রতিবছর আমের মৌসুমে ঢাকা,চট্রগ্রাম, কুমিল্লা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বিক্রি করা হয় খাগড়াছড়ির আম্রপালি।এ‘আম চাষ বদলে দিচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও অর্থনীতি। আবহাওয়া ও মাটি দুটাই অনুক‚লে থাকায়,বাণিজ্যিক ভাবে হাজার হাজার কৃষক চাষ করছে আম্রপালি, হিমসাগর, লেংড়া সহ বিভিন্ন জাতের আম। সু-মিষ্ট আম্রপালী জাতের আমকে পার্বত্য এলাকার (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান) নতুন অর্থকরী ফসলও বলা হচ্ছে।প্রতিবছরই বাড়ছে এ আম চাষের পরিধি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়,পাহাড়ের পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে অনগ্রসর মানুষ গুলোকে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্ভী করতে ২০০২ সালে কমলা, মালটা, মিশ্র ফলসহ নানান প্রকল্প গ্রহন করা হয়।এর ধারাবাহিকতায় রাজশাহীর মত আম চাষের বিকল্প প্রকল্প হিসেবে পরীক্ষামুলক কিছু আম্রপালি আমের চারা রোপন করা হয়।এক বছরে গাছে ফল দেখে ২০০৪ সালে পটিয়া ফল গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম দফায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবারকে প্রকল্পের মাধ্যমে এ আমের চারা,ও পরিচর্যার খরচ সহ দিয়ে উৎসাহীত করা হয়েছে ।এরপর পাহাড়ে আম্রপালি উৎপাদন বানিজ্যিক ভাবে শুরু হয় এবং ১ বছরের মধ্যে দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্থানীয় ভাবে চারা উৎপাদন করে ব্যপক হারে বিতরণের প্রকল্প নেয়া হয়েছিলো।গরিব কৃষকদের এক মৌসুমে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করতে দেখে,অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আম্রপালি আমের চাষ শুরু করেন। উৎকৃষ্ট এবং উচ্চ মানসম্পন্ন সু-মিষ্ট শংকর জাতের এই আমটির ভক্ত রয়েছে সারা দেশব্যাপি।আম্রপালি তার পিতৃ ও মাতৃ গুণের (দশেরী ও নিলম) চেয়ে অনেক উন্নত ও সুস্বাধু। ফলটি দেখতে লম্বাটে, নি¤œংশ অনেকটা বাঁকানো। আম্রপালি দুই জাতের, একটির গঠন ছোট অপরটি তুলনামূলক বড়।ছোট জাতের গড় ওজন ১৭০ গ্রাম এবং বড়টির গড় ওজন ২৫০ গ্রাম। পোক্ত অবস্থায় ত্বকের রং সবুজ অথবা লালচে হলুদ হয়।পাকলে খুব সুন্দর রং ধারন করে।ত্বক মসৃণ এবং খোসা পাতলা হয়।আমটি অত্যন্ত রসালো, সুস্বাদু এবং সুগন্ধযুক্ত। গাছে প্রচুর ফল ধরে এবং প্রতি বছর ফল আসে। আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে ফল পাকা শুরু হয়। ফুল আসা থেকে পরিপক্ক হতে পাঁচ মাস সময় লাগে। ফল সংগ্রহের পর পাকতে ৫-৬ দিন সময় লাগে।বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল এবং বাংলাদেশে বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় আম হচ্ছে আম্রপালি। স্বরজমিনে দেখা যায়, খাগড়াছড়ির গুইমারার বড়পিলাক, হাফছড়ি, ছাড়াও দীঘিনালা, পানছড়ি, মহালছড়ি সহ জেলার প্রায় সব কটি উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ যেখানেই যাবেন চোখে পড়বে আম চাষের নান্দনিক দৃশ্য। উঁচু নিচু ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুকজুড়ে চারদিকে সারি করে সাজানো গোছানো ভাবে লাগানো হয়েছে আম গাছ। পথের ধারে, প্রতিটি বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায়, বাড়ির উঠানেও দাঁড়িয়ে আছে আমগাছ। প্রতিটি গাছে শত শত আম ঝুলছে মনোরম দৃশ্যে। আম ব্যবসায় সম্পৃক্ত এলাকার বেকার যুবকেরা ।এ জাতের আম চাষের কারনে পার্বত্য এলাকায় বেকারের সংখ্যাও কমেছে বলে ধারনা করছেন অনেকে। গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের সফল আম চাষী বাবুল গাজী ও মফিজ মাষ্টার সহ কিছু আম চাষী জানান, উন্নয়ন বোর্ডের সার্বিক সহযোগিতায় তাদের বাগান গড়ে উঠেছে। চলমান লকডাউনের কারনে যথাসময়ে বাজারজাত করন নিয়ে একটু হতাশা থাকলেও, ফলন ভালো হওয়ায় খুশি তারা। বাজার ভালো থাকলে আম বিক্রি করে গতবারের চেয়ে ও বেশী লাভ হবে বলে সকলে আশাবাদী। অপর দিকে করোনা ভাইরাসের কারণে যথাসময়ে আম বাজারজাত করন নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় আম ব্যবসায়ীরা । খাগড়াছড়ি কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, জেলার ৯টি উপজেলায় ৩ হাজার ৩৬৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে।গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ও ভালো হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় পাচঁশ কোটি টাকার আম বিক্রি হচ্ছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন বাগান। মাঠ কর্মীরা প্রতিটি উপজেলায় কৃষকদের আম চাষের বিষয়ে সু-পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। জুনের শুরু থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে আম্রপালি, হিমসাগর সহ বিভিন্ন জাতের আম।