শিক্ষকতা হলো মহান পেশা। এ ধরণের আদর্শিক পেশার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য সকলের হয় না। যাঁর জীবনে এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ এসেছে তাঁকে শেখার মনোবৃত্তি নিয়ে পাঠদান করতে হবে। এখানে বিনিময়ে পাওয়া কিংবা স্বার্থের বিনিময়ে বিদ্যাদান কাম্য নয়। তবে প্রত্যেক পেশার মানুষের কিছু পেশাগত দায়িত্বকর্তব্য থাকে যা তার পেশাগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। একইভাবে যাঁরা শিক্ষক তাঁদের কিছু পেশাগত বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। যেমন, যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক তাঁর সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়।
আবার শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চাই তার থেকেও তা কিভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আবার জ্ঞান ছড়িয়ে দিলেই হবে না, যে বা যারা তা গ্রহণ করছে তা তারা আদৌ গ্রহণ করতে পারছে কিনা, পারলেও কতটা গ্রহণ করতে পারছে ইত্যাদিও দেখার বিষয়। আর তা সার্থক ভাবে সম্পন্ন করতে হলে প্রয়োজন-দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রায়োগিক জ্ঞান। শিক্ষকদের সে সকল দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জনের জন্যই প্রয়োজন পেশাগত উন্নয়ন। একজন শিক্ষককে তাঁর পেশার উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিনিয়ত নব নব জ্ঞান ও কৌশলের সন্ধান করতে হয়। পাঠদানকে শতভাগ সফল করতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিক জ্ঞান-গবেষণার সন্ধানে নিরলস প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়। যেকোনো মানুষের জীবনে সাফল্য আনতে হলে পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নের প্রয়োজন পড়ে। পেশাগত দক্ষতা অর্জন ব্যতীত প্রকৃত সাফল্য অর্জন করা যায় না। এ কথাটি অন্যান্য পেশার ন্যায় শিক্ষা পেশায়ও সমভাবে প্রযোজ্য।
কেন না শিক্ষাদান করাও একটি মহান পেশা। যে পেশার উন্নয়নে জ্ঞানদক্ষতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কোনো কাজের অর্পিত দায়িত্ব পালনের সময় মেধা, শ্রম ও সময়কে সদ্ব্যবহার করে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের মৌলিক ক্ষমতাকে দক্ষতা বা স্কিল বলে। শিক্ষকের পেশাগত মূল্যবোধ, আত্মপ্রত্যয় ও বোধগম্যতার সমন্বয় ঘটিয়ে শ্রেণি-পাঠদান সার্থক করতে হয়। আর এসব পদ্ধতি ও কৌশলকে আয়ত্ব করতে হলে শিক্ষকের জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়ন করতে হয় এবং যথাসময়ে যথোপযুক্ত পাত্রে প্রায়োগিক দিকের প্রতি নজর দিতে হয়। তাই একজন শিক্ষকের জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়ন সাধনের জন্য যে সব বিষয়ে প্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। শিক্ষক হচ্ছেন তথ্য ও জ্ঞানের উৎস। তাই তাঁকে প্রতিনিয়ত অজানাকে জানার দুর্নিবার স্পৃহা নিয়ে জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। নতুন নতুন তথ্য তাঁর জ্ঞানভান্ডারে সংযোজন করতে হবে। শিক্ষার্থী কর্তৃক উপস্থাপিত সকল বিষযে শিক্ষকের জ্ঞান না-ও থাকতে পারে সেক্ষেত্রে কোনোরূপ অস্পষ্টতার আশ্রয় না নিয়ে পরবর্তীতে জেনে-বুঝে সমাধান দেয়া সমীচীন হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যেন শ্রেণির পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। আধুনিক শিক্ষা-মনোবিদের মতে, একজন শিক্ষকের আত্ম-মূল্যায়নের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ্যারেন্ডস বলেছেন, শিক্ষক কী করছেন এবং শিক্ষকের কার্যাবলি শিক্ষার্থীর সামাজিক ও একাডেমিক শিক্ষনে কি প্রভাব ফেলছে তার উপর নির্ভর করে কার্যকর শিক্ষণ। আগামী প্রজন্মের চাহিদাকে সামনে রেখে শিক্ষককে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সকল বিষয় শিক্ষকের জানা থাকবে এটা না-ও হতে পারে। তাই তাকে অজানা বিষয়কে জানার শিক্ষকের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তদুপরি সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যদিয়ে অসীম জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণ করা যাবে না। আর নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে কাঙ্খিত পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন সুদূরপরাহত হবে, যা কারোরই কাম্য নয়। কাজেই দক্ষতা উন্নয়নের জন্য একজন শিক্ষককে অবশ্যই জ্ঞান জগতের নব নব দিগন্তে প্রবেশ করে সর্বশেষ শিক্ষণ-প্রযুক্তি ও গবেষণার তথ্য-কৌশল আয়ত্ব করতে হবে।
এতদ্ব্যতীত শিক্ষক-পেশায় অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসাবে তাঁর উপস্থিতি দীর্ঘ করতে পারবেন বটে কিন্তু নিজস্ব উৎকর্ষতার দ্যুতি বিস্তৃত করতে পারবেন না। তাঁর দ্বারা নিজের ভেতরে থাকা দুর্বলতাকে কর্মসহায়ক গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করে এর উন্নয়ন ঘটানো কখনো সম্ভব হবে না। শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে তা হচ্ছে সেল্ফ এ্যাভিওলেশন বা আত্ম-মূল্যায়ন। কেন না শিক্ষকের যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করার জন্য সহজতর ও অতীর কার্যকরী উপায় এটি। শিক্ষক এর দ্বারা যোগ্যতা অর্জনের প্রতিটি পদক্ষেপে সচেতন বিশ্লেষণ করতে পারেন ও প্রয়োজনীয় কৌশল ব্যবহার করে যোগ্যতার উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। প্রসিদ্ধ লিকার্ট স্কেল ও প্রয়োজনীয় কৌশল ব্যবহার হতে পারে। কেন না এর মাধ্যমে শিক্ষক তাঁর অর্জিত যোগ্যতার মান পর্যবেক্ষণপূর্বক নিজেকে যোগ্যতার সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতে পারেন। সভ্যতার শুরু থেকেই শিক্ষককে মনে করা হয় সকল জ্ঞানের আধার। তাই তাঁকে অগাধ পাÐিত্যের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। সীমিত জ্ঞান দ্বারা শিক্ষকতার মতো বৃত্তিতে গ্রহণ করা যায় না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী। তারা নানা, প্রসঙ্গে তাঁর জ্ঞানের পরীক্ষা নিবে। তাদের জ্ঞানপিপাসা তৃপ্ত করতে না পারলে শিক্ষকের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা হ্রাস পাবে। তাই শিক্ষককে জীবনব্যাপী শিক্ষার্থীর অভিপ্রায় নিয়ে নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক, কখনো বিষয়ের বাইরেও অধ্যয়ন করতে হবে। নিত্য নতুন বিষয় যেমন জানতে হবে। তদ্রæপ জানা বিষয়কে আবার জ্ঞানচর্চার নজরে আনতে হবে।
শিক্ষকত বা অধ্যাপনাকে অর্থোপার্জনের মাধ্যম না ভেবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ ভাবতে হবে। এ-ক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের আগে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে ভুলে না যাই। যত জানা বিষয়ই হোক তার পরও পাঠ্যবিষয়ের পূর্বধারণা নিয়ে পাঠদান করা প্রয়োজন। প্রতিদিনের পাঠদানে নতুন কোনো কিছু সংযোজ করা যায় কিনা তা চিন্তার জগতে নিয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে যে বিষয়ের পাঠদান করা হবে সে বিষয়ের উচ্চতর কোনো রেফারেন্স বই অধ্যয়ন করা হলো কিনা সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্য কিংবা রেফারেন্স বই সংগ্রহে থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে যে,শিক্ষক যদি নিত্য নতুন তথ্য সরববাহ করতে না পারেন কিংবা ঘটে যাওয়া বিষয়ের সর্বশেষ সংবাদ না রাখেন তবে শিক্ষার্থীরাই এক সময় তাঁর প্রতি আকর্ষণ হারাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জীবনে সার্বিক অগ্রগতির জন্য পেশাগত উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে কেউ কর্মক্ষেত্রের উপযুক্ত একজন সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠেন। প্রক্রিয়াটি সারা জীবন ধরেই চলতে থাকে। মানুষ কিভাবে জীবিকা বা খাওয়া-পরার সংস্থান করে, সে ব্যাপারে প্রথম যখন কেউ ভাবতে শেখে, পেশাগত চিন্তা-ভাবনাও ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়। শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন মূলত শিক্ষার্থীর উন্নয়নের জন্য তথা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য। তাই শিক্ষককে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞত বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পেশাগত উন্নয়ন ও শিক্ষকের ভূমিকা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য আজকের বিশে^ শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়ক। শিক্ষককে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন অনলাইন ট্রেনিং প্রোগ্রাম, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন, শিক্ষাক্ষেত্রে নিত্যনতুন আবিষ্কার, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এখন খুব সহজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে জানা সম্ভব। সেজন্য শিক্ষককে জ্ঞান পিপাষু হতে হবে। সুতরাং শিক্ষককে নিজের দায়িত্বের প্রতি সচেতন হয়ে নিজেকে সময়পোযোগি করে গড়ে তুলতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে এবং বর্তমান প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ সমাজের কার্যকরি নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের শিক্ষকদেরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা বিবেচনা করে নিজেদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে।
লেখক- বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রধান শিক্ষক,জিনজিরা পী.এম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়,কেরাণীগঞ্জ।