ফুলবাড়ী, দিনাজপুর প্রতিনিধি
মধু মাসে আম ও লিচুতে ঝুলে পড়েছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আম ও লিচু গাছ। আর সপ্তাহ খানেক গেলে পুরোদমে বাজার ভরে উঠবে আম ও লিচুতে। মধুমাসের ফল বাগান মালিকরা বেচাকেনা নিয়ে যেমন ব্যস্ত সময় পার করছেন, তেমনি আম ও লিচু বহনের ঝুড়ি (টুকরি) তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার মাহালী সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষরা। আম ও লিচু মৌসুমে এ এলাকার আম ও লিচুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নিজ নিজ বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে মধু মাসের আম ও লিচু পাঠানো একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে নিজ নিজ দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের কাছেও আম ও লিচু পাঠিয়ে থাকেন প্রতি বছর। এ কারণে এ সময় আম ও লিচু বহনের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন হচ্ছে বাঁশের বাতার তৈরি ঝুঁড়ি (টুকরি)। বছরের অন্য সময়ে মাহালীদের কাজ না থাকলেও এ সময়ে কাজের চাপে তাদের দম ফেলানোর ফুরসত থাকে না। এ সময়ের আয় দিয়েই বছরের বেশি সময় পার করতে হয় তাদের।
সরেজমিনে ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের জয়নগর মাহালীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামে ৩৬ মাহালী পরিবারের পৈত্রিক সূত্রে বসবাস। বয়স্ক নারী ও পুরুষরা তাদের বাপ-দাদার পেশাকে আকঁড়ে ধরে আছেন। তবে তাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে অনেকে চাকরি অথবা পেশা বদল করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। বাঁশের তৈরি আম ও লিচু বহনের ঝুঁড়ি (টুকরি) তৈরি নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন ওই গ্রামের স্টীফান সরেন ও তার স্ত্রী মিনা মার্ডী, সুধির মার্ডী ও তার স্ত্রী সোনামনি হেম্ব্রমসহ সুজন মার্ডী, হেম চন্দ্র মার্ডী, রমেশ মার্ডীসহ গ্রাসের প্রায় সকল নারী ও পুরুষ বাঁশ-বেত শিল্পী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় তাদের সঙ্গে। বাঁশ-বেত শিল্পী সুধির মার্ডী ও তার স্ত্রী সোনামনি হেম্ব্রম বলেন, প্রতি বছর আম ও লিচু বহনের জন্য তাদের তৈরি ঝুঁড়ি বা টুকরির বেশ চাহিদা থাকে। এ কারণে তারাও আগেভাগেই এগুলো সাধ্যমত তৈরি করে মজুত রাখেন। ফল ব্যবসায়িরা গ্রামে গিয়েই চাহিদানুযায়ী ঝুঁড়ি কিনে থাকেন। এখনও লিচু কিংবা আম পুরোপুরি পরিপক্ক না হওয়ায় ঝুঁড়ির চাহিদা এখন তেমন নেই। তবে একপক্ষ কালের মধ্যেই ব্যাপক চাহিদা হবে তাদের তৈরি ঝুঁড়ির। তবে প্লাস্টিকের ক্যারেট বাজারে আসার কারণে মাহালীদের তৈরি বাঁশের ঝুঁড়ির চাহিদা একটু কমে গেছে। তবে লিচু পরিবহনে পুরোটাই তাদের তৈরি ঝুঁড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে এখনও।
স্বামী-স্ত্রী মিলে দিনে ৮ থেকে ১০টি ঝুঁড়ি তৈরি করেন তারা। বর্তমানে একটি মাঝারী সাইজের বাঁশ কিনতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। একটি বাঁশে সর্বোচ্চ সাতটি ঝুঁড়ি তৈরি হয়। এক-একটি লিচুর ঝুঁড়ি বিক্রি হয়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। এতে পরিশ্রম অনুযায়ী খুব বেশি লাভ হয় না। তাছাড়া প্লাস্টিকের দাপটে পূর্বের মতো আর বাঁশের পণ্যের চাহিদা নেই। তবুও শত কষ্টের মধ্যেও বাপ-দাদার পৈত্রিক পেশা ধরে রেখেছেন গ্রামের অনেকেই। তবে বছরের অন্য সময়ে বাঁশের বাটাই, কুলা, ডালা, টুকরি, চালনি, মাছ ধরার হেঙ্গা, খলইসহ নানা ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন। ফুলবাড়ী পৌর শহরের ফল ব্যবসায়ী ভুলু কান্ত মোহন্ত ও কানুকান্ত মোহন্ত বলেন, বাঁশের তৈরি ঝুঁড়িতে আম পরিবহণ করলে ঝুঁড়ি অনেক সময় উঠানামা করতে দুমড়ে মুচড়ে যায় এতে ফলের ক্ষতি হয়। আবার এক বারের বেশি ঝুঁড়ি ব্যবহার করা যায় না। আর প্লাস্টিকের ক্যারেটে এগুলো ভয় থাকে না। এগুলো অনেকবার ব্যবহার করা যায় নির্বিঘ্নে। এ কারণে প্লাস্টিকের ক্যারেট বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। উপজেলার দৌলতপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, শত কষ্টের মধ্যেও এলাকার মাহালী সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাদের তৈরি বাঁশ ও বেতের পণ্য পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এটি ব্যবহারে এগিয়ে আসা উচিৎ। পরিবেশ বান্ধব এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।