খায়রুল আলম রফিক :
বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবের লাইসেন্স, অনলাইন আবেদন, রাতে গোপনে অবৈধ ক্লিনিকের অভিযানের তালিকা করে ঘুষ আদায় করা। দুর্নীতিবাজ কতিপয় কয়েকজন ৪ শ্রেনীর কর্মচারী সিভিল সার্জনের নামে সেবা গ্রহীতাদের ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে আদায় করছেন এই ঘুষের টাকা। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকগন জিম্মি হয়ে পড়েছে ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী আরিফের কাছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে সিভিল সার্জন অধস্তন ও সহকর্মীদের দাপট দেখান এমরান মেহেদী আরিফ। ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে দূর্নীতি- অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক তদন্ত শুরু করেছেন। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় তারাও প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কমকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে যেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব মালিকরা নতুন লাইসেন্স ও পুরনো লাইসেন্স নবায়নে অনলাইন আবেদনের পর পরিদর্শনের জন্য ভিড় জমান সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগান ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসান আরিফ। বিভিন্ন কৌশলে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করেন। অভিযোগ রয়েছে তার রয়েছে দালাল বাহিনী। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ভাড়াটিয়া বাহিনী দিয়ে পথে- ঘাটে প্রাননাশের হুমকিসহ হয়রানি করা হয়। দালালের মাধ্যমেই ক্লিনিক মালিকদের কাছ টাকা তুলেন ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী আরিফ। অনুসন্ধানে জানাযায়, প্রায় ৫শ” হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা আদায় করেন ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসান ওরফে আরিফ। তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর দুটি অভিযোগ জমা হয়েছে। গত বছর ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) দপ্তরে একটি তদন্ত হয়। উক্ত তদন্তে এমরান মেহেদী হাসান আরিফের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের সত্যতা মিলে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ডিজি (স্বাস্থ্য) এর কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়,তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলি করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেন।দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের স্বারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.১৪১.২১-২৯০৬৮ তারিখ-২৬-০৯-২০২১। প্রচার রয়েছে, ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদি হাসান নিজেকে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এর আত্বীয় পরিচয় দেন। তবে প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এর স্বজনরা জানান, তাদের কোন আত্বীয় হয় না। দীর্ঘদিন অনলাইনে আবেদন জমা নেয়া, লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স প্রদান বন্ধ থাকার পর চালু হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব মালিক কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে ভুক্তভোগী সূত্রগুলো জানায়, প্রতিটি লাইসেন্স নবায়নের জন্য সিভিল সার্জনের নামে ২০ হাজার ও ডিজির নামে ৫০ হাজার টাকা করে এবং নতুন লাইসেন্সের জন্য ৯০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হয়েছে। এই হিসেবে ময়মনসিংহ মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাবের কাছ থেকে সিভিল সার্জনের নামে আদায় করা হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। এর বাইরে ভালুকা, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, হালুয়াঘাট উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা স্বাস্থ্য সেবার প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসান ওরফে আরিফ প্রায় ৩ কোটি টাকা টাকা তুলেন বলে জানাগেছে। চরপাড়া মেডিক্যাল কলেজ গেট এলাকার বেসরকারী হাসপাতাল মালিক বিউটি অভিযোগ করে জানায়, লাইসেন্স নবায়নের জন্য সিভিল সার্জনের পরিদর্শনের সময় তাকে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা গুনতে হয়েছে।
নতুন বাজার মোড়ের একটি মিষ্টির দোকানের ভেতর ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদীর সঙ্গে ঘুষের টাকা লেনদেন করেন তিনি। চাহিদার ৩০ হাজার টাকার ঘুষ না পেয়ে এর মাত্র ১৫ দিন পর ফের তার হাসপাতাল পরিদর্শনে যান সিভিল সার্জন ডা: নজরুল ইসলাম। এ সময় তার কাছে আরও টাকা দাবি করলে এক পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয় ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসান। হয়রানির ভয়ে বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব মালিক মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না। নগরীর বাঘমারা রোডে বেসরকারী একটি ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য সিভিল সার্জনকে ৫০ হাজার টাকার ঘুষ লেনদেনের একটি ফোনালাপ নিয়ে তোলপাড় চলছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নামকাওয়াস্তে কোন কোন হাসপাতাল ও ল্যাব পরিদর্শনে গেলেও বেশিরভাগ পরিদর্শন ছাড়াই কেবল টাকার বিনিময়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। পরিদর্শন টিমের একাধিক সদস্য অবশ্য স্বীকার করেন এটি সিভিল সার্জন কার্যালয় প্রস্তুত করার পর তাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরিদর্শন টিমের সদস্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ডাঃ রাজীব হাসানের কাছে সর্বশেষ কোন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে পারেননি। প্রচার রয়েছে, পরিদর্শন টিমের সদস্যরা পরিদর্শন ছাড়াই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করে ভাগ পান ঘুষের টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারী-বেসরকারী সংস্থায় নিয়োগলাভের পর মেডিক্যাল ফিটনেস সনদের জন্য প্রার্থীরা ভিড় জমান সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে। বছরে গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ প্রার্থী এই সনদ নিচ্ছেন। এসব প্রার্থীদের এই সনদ নিতে পছন্দের বেসরকারী ল্যাবে পাঠিয়ে প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ৬,৯০০ টাকা হারে বাধ্যতামূলক বিভিন্ন টেস্ট করাতে হয়। অথচ সরকারী হাসপাতালে এই টেস্ট করা হলে ফি লাগত মাত্র ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। প্রচার রয়েছে, করোনাকালে সিভিল সার্জন মেডিক্যাল ফিটনেস সনদের বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন দুই কোটি টাকা।
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩২ শিক্ষকের এই সনদ নেয়ার সময় ঘটনা জানাজানি হলে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে মাত্র ৩০০০ টাকার ফি’য়ে বিভিন্ন টেস্ট করাতে সক্ষম হন। এসবের বাইরে সরকারী চাকরিজীবীদের কেউ অসুস্থতার জন্য মেয়াদের আগে অবসরে যেতে চাইলে মেডিক্যাল বোর্ডের সনদ প্রয়োজন। এজন্য সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে রয়েছে ৩ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। অভিযোগ রয়েছে এই সনদের জন্য ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। অসুস্থ এক চালকের কাছে এই সনদের জন্য চাওয়া হয়েছিল ৭০ হাজার টাকা। পরে অবশ্য অনেক ধরাধরির পর কিছুটা কম টাকায় রফা করেন ওই চালক। ময়মনসিংহ সিভিল সার্জনের ফেসবুক পেজের পরিসংখ্যানে এই তথ্য মিলেছে। সেখানে সিভিল সার্জন এক পোস্টে লেখেন নগরীর চরপাড়া এলাকার চৌধুরী হাসপাতাল, নিউ আরাফা হাসপাতাল, আল আরাফা হাসপাতাল, উত্তরা হাসপাতাল, স্পন্দন হাসপাতাল, দি কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মিতা ক্লিনিক, ভাটিকাশর জমির বেপারী লেন আল মদিনা স্পেশালিস্ট হাসপাতাল পরিদর্শকালে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র পাওয়া গেছে। অনুমতি না নিয়েও ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করেন।
এ সময় যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেই সেসব প্রতিষ্ঠানের রোগীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে লাইসেন্স না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নিদের্শ দেন। আর যে সকল প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি এবং পরিদর্শনকালে বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া গেছে তাদের সংশোধনপূর্বক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিভিল সার্জনের কাছে জবাব দিতে বলা হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়া হয়েছিল। এসবের কোনটিরই কার্যকর হয়নি। গুঞ্জন রয়েছে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সিভিল সার্জন ক্যাশিয়ার মেহেদী হাসানের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু রফা করেছেন। পরিদর্শনে পছন্দের খাবার কোয়েল পাখি,কবুতর, সঙ্গে খাম, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনের আগেই ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসানের কাছে জেনে নিতে হয় সিভিল সার্জন কী খাবার পছন্দ করেন। গিফটের খাম কেমন হবে ইত্যাদি। জানা গেছে, সিভিল সার্জনের পরিদর্শনের সময় পছন্দের খাবার কোয়েল পাখি, কবুতর, দেশী মুরগি, শুঁটকি থাকতেই হবে। তবে সব মিলিয়ে ১২-১৩ পদের নিচে নয়। সিভিল সার্জনকে খুশি রাখতেই এই রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে এখন ময়মনসিংহের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে। একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানালেন, সিভিল সার্জন ডা: নজরুল ইসলামকে খুশি করতে তিনি ১২ পদের খাবার আয়োজন করেছিলেন। তারপরও মন পাননি। স্বাস্থ্য বিভাগের এই সিন্ডিকেট শুধু ময়মনসিংহে নয় এমন সিন্ডিকেট নেত্রকোনা জেলাও রয়েছে। নেত্রকোনা জেলা শহরের বেসরকারি ক্লিনিক এনাম মেডিকেল ও হাসপাতাল, তানিয়া হাসপাতাল এবং লিবার্টি হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ভাবে চলছে। যার নেপথ্য রয়েছে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক টিটু রায়।
তিনি নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে সিভিল সার্জন অফিস ম্যানেজ করে দেবেন বলে এসব অবৈধ হাসপাতাল খোলার ব্যবস্থা করেন। ডাক্তার টিটু রায় এর শর্ত হলো হাসপাতালের সব অপারেশন এনেস্থিসিয়া দেবেন তিনি। ডাক্তার টিটু রায় এর অনিয়মের অভিযোগ সর্ব মহলে কিন্তু রাজনৈতিক দলের দোহাই দিয়ে এভাবেই চলছে তার অবৈধ কার্যক্রম। ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ক্যাশিয়ার এমরান মেহেদী হাসান ওরফে আরিফ জানান, আমার নামে সংবাদ প্রকাশ করার আগে জেনে নিবেন আমি কে? আমি গনপুর্ত মন্ত্রীর আত্বীয় এবং তার কাছের লোক। যা করবেন জেনে শুনে করবেন। ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডা: নজরুল ইসলাম জানান, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সত্য না, আমি বাইরে আছি পরে ফোন দিয়েন।