মো.শহিদুল ইসলাম:
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছগলের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রাম পর্যায়ের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের দিকে দাবিত করতে হলে ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনের বিকল্প নেই। এ জন্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯-২০অর্থবছরে জিডিপি’তে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৩শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩দশমিক০৪ শতাংশ। সার্বিক কৃষি খাতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৩দশমিক ৪৪শতাংশ(লাভস্টক ইকোনোমী তথ্য)। জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদ খাতের অংশ স্বল্প হলেও মানুষের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রাণিসম্পদের মধ্যে ছাগল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ। ছাগল বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ ও বিশ্বে ছাগল পালনে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান দখল করে আছে। আমাদের দেশে আদিকাল থেকে যে ছাগল লালিত পালিত হচ্ছে তা ব্যাক বেঙ্গল ছাগল, আর বিদেশ থেকে বিশেষত: ভারত থেকে আমদানীকৃত রামছাগল। এ দেশের আবহাওয়া ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনে অত্যন্ত উপযোগী। ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব দূরিকরণ এবং দারিদ্র বিমোচন সহজেই সম্ভব। ব্যাক বেঙ্গল” পৃথিবীর ৫টি সেরা মাংস উৎপাদন জাতের মধ্যে অন্যতম। এদের বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা অধিক, মাংস সুস্বাদু, চামড়া আন্তর্জাতিক মানের, দেশের জলবায়ুতে এর জীবনযাপনের উপযোগিতা বেশি এবং দারিদ্র বিমোচনের হাতিয়ার।
দেশে বিদ্যমান ছাগলের অধিকাংশই ব্যাক বেঙ্গল জাতের। এ জাতের ছাগলের মাংস সুস্বাদু, চামড়া উন্নতমানের, বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা বেশি এবং বাচ্চার মৃত্যুর হার কম। সাধারণ দরিদ্র জনগণ স্বল্প খরচে অনায়াসে এ জাতের ছাগল পালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। ব্যাক বেঙ্গল ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রাম ছাগলের চেয়ে বেশি, ফলে বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের চিকিৎসার খরচ, বিড়ম্বনা এবং মৃত্যুহার কম। ব্যাক বেঙ্গল ছাগল রাম ছাগলের চেয়ে অনেক আগে বয়ো:প্রাপ্ত হয় এবং একই সময় রাম ছাগলের তুলনায় ২ থেকে ২.৫ গুণ বেশি বাচ্চা জন্ম দেয়। ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের মাংস ও চামড়ার গুনাগুণ রাম ছাগলের চেয়ে উন্নত।
তবে প্রজনন(ব্রিডিং) কার্যক্রমের যথাযথ রেকর্ড না থাকায় অন্য জাতের সাথে ব্রিডিং/ ইনব্রিডিং এর কারণে দিন দিন ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের কৌলিক মান হারাচ্ছে। বিদ্যমান সরকারি খামারগুলোর অবকাঠামো অনেক পুরাতন হওয়ায় ছাগল উৎপাদন, জাত সংরক্ষণ, স¤প্রসারণ প্রভৃতি কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে ছাগল পালনের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে সঠিক প্রজনন সেবা নিশ্চিত করা, ছাগল পালনে আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে খামারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রদর্শনী খামার স্থাপন, ছাগল পালনে দক্ষ জনবল তৈরি করা, ছাগল পালনে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সরকারি খামারগুলো থেকে উপজেলা পর্যায়ে খামারীদের ছাগল পালনে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য বিদ্যমান ৭টি সরকারি ছাগল খামারের সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও স¤প্রসারণ প্রকল্প” শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের কার্যক্রম দেশের ২৩টি জেলার ১৯৭ টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পটির ১ম সংশোধিত অনুমোদিত মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৭.৬৩ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নকাল জানুয়ারি ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত।
এই প্রকল্পের আওতায় প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি উপজেলায় নির্বাচিত ছাগল পালন খামারী, পাঁঠা পালনকারী ও ছাগল উন্নয়ন কর্মী’দের মাঝে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দ্বারা অংশগ্রহণকারী সকল প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে করণীয়, রোগ প্রতিরোধ, টিকা প্রদান, ছাগলের বিকল্প দুধ হিসেবে মিল্ক রিপ্লেসার তৈরি করে খাওয়ানোর নিয়মাবলি, প্রাকৃতিক প্রজনন সেবাসহ ছাগলের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয় ও হাতে কলমে শেখানো হয়। উক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ের খামারীদের দেশীয় জাতের ছাগল লালন পালন ও সংরক্ষণ উৎসাহিত করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় এপ্রিল-২০২২ পর্যন্ত ১৮৯ জন প্রান্তিক পর্যায়ের ছাগল খামারিকে ছাগল পালনের উপর ৩ (তিন) দিনের আবাসিক ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, ১৯৭০ জন খামারিকে একটি করে বিজ্ঞানসম্মত মাঁচাযুক্ত ছাগলের মডেল সেড/ঘর প্রদান করা হয়েছে, ছাগলের বাচ্চার পুষ্টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মিল্ক রিপ্লেসার এবং কৃমিনাশক ও অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়েছে। জাত উন্নয়নের জন্য প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে বিদ্যমান পাঁঠাসমূহের মধ্য থেকে সঠিক কৌলিকমান সম্পন্ন ব্যাক বেঙ্গল জাতের পাঁঠা চিহ্নিত করে প্রতি উপজেলায় একজন বø্যাক বেঙ্গল জাতের পাঁঠা পালনকারীকে একটি করে বিজ্ঞানসম্মত মাঁচাযুক্ত ছাগলের মডেল সেড/ঘর প্রদান করা হয়েছে ও উক্ত পাঁঠাসমূহের ব্রিডিং রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
এসকল সহায়তা প্রাপ্ত প্রান্তিক খামারিদের মাঝে অধিক পরিমাণ ছাগল পালনে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, ব্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সুলভমূল্যে ছাগল খামারীদেরকে প্রদানের লক্ষ্যে ৭টি সরকারী ছাগল খামারের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোসমূহের সংস্কার/উন্নয়ন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে এ ধরনের সরকারি উদ্যোগ প্রান্তিক পর্যায়ের খামারীদেরকে ছাগল পালনে উদ্বুদ্ধ করবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় প্রতি উপজেলায় বর্ণ্যাঢ্য র্যালির মাধ্যমে প্রতি বছর ছাগল এক্সিভিশন মেলা ও পুরষ্কার এর আয়োজন করা হয়। এই মেলার মাধ্যমে উপজেলা ভিত্তিক প্রতিটি খামারীদের ছাগল লালন পালনে আরো উৎসাহিত প্রদান করা হচ্ছে।
খামারী পর্যায়ে ব্যাক বেঙ্গল ছাগলের প্রাকৃতিক প্রজনন সেবা প্রদান, অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণ দ্বারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রয়নের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ছাগল পালন ও পাঁঠা পালনে আগ্রহী দক্ষ জনবল তৈরিতে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় “ব্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও স¤প্রসারণ প্রকল্প” ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাতটি পুনরুদ্ধার হচ্ছে ও খামারীরা বø্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে আরও উৎসাহিত হচ্ছে এবং ছাগলের এই ব্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে বেকারত্ব দূরীকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হচ্ছে। সারাদেশ ব্যাপি প্রকল্পটি গ্রহণ করা যেতে পারে এবং ছাগলের কৌলিকমান বৃদ্ধির জন্য ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম গ্রহণ এবং মাঝারি আকারের খামারীদের ইনপুট সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে ছাগলের মাংস রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব হবে।