ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক ও আইনজীবীদের মুখোমুখী অবস্থানে বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। জেলা বার সভাপতিসহ তিন আইনজীবীকে হাইকোর্টে তলব। চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ বিচার প্রার্থীরা। জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে এজলাস চলাকালে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট তানবীর ভূইয়ার নেতৃত্বে আইনজীবীদের বাদানুবাদের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিচার বিভাগের বিচারক ও অন্যান্য কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এদিকে আইনজীবী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতি নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ তুলে ১ জানুয়ারি থেকে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা। এ বিষয়ে বিচারক মোহাম্মদ ফারুক বলেন, এজলাসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিচারককে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করা সংবিধান ও আইন বিরোধী। এটা একাধারে ফৌজদারি অপরাধ, আদালত অবমাননার শামিল। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট তানভীর ভূঁইয়া। তিনি বৃহস্পতিবারে বলেন, তিনি বিচারককে গালিগালাজ করেননি। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সম্পাদনা করা। এদিকে দুই বিচারকসহ নাজিরের অপসারণ চেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল আদালত ৩ দিনের জন্য বর্জন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আইনজীবীরা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আদালত বর্জন করে জেলা আইনজীবী সমিতির সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এ সময় বক্তব্য রাখেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট তানবীর ভূইয়া, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বাবুল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম লিটন, মাহবুবুল আলম খোকন প্রমূখ। এ সময় বক্তারা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল -১ এর বিচারকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ এনে বলেন, গেল ১ ডিসেম্বর বিকেলে মামলা দায়ের করতে গেলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল -১ এর বিচারক মামলাটি গ্রহণ না করে জেলার সকল আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্য করেন।
এর আলোকে ২৬ ডিসেম্বর সভা করে ১ জানুয়ারি থেকে সংশ্লিষ্ট আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় জেলা আইনজীবী সমিতি। সে সাথে জাল স্ট্যাম্প, জালিয়াতির উৎস ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে দেয়ায় ঘুষখোর ও ঘুষখোরের মদদদাতা আদালতের নাজির মুমিনকে প্রত্যাহারের দাবি জানায় জেলা আইনজীবী সমিতি। অথচ তাকে রক্ষায় জেলা জজের ইন্ধনে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করেছে বিচার বিভাগীয় কর্মচারীরা। এরই প্রতিবাদে জেলার আইনজীবীরা জেলা জজ শারমিন নিগার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের-১ এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুক ও আদালতের নাজির মোমিনুল হকের অপসারণের দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার, আগামী রবি ও সোমবার পর্যন্ত ৩ দিনের জন্য সকল কোর্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। দাবি আদায় না হলে কর্মসূচি চলমান থাকবে বলেও জানায় বক্তারা। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, সময় পার হয়ে যাওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের-১ এর বিচারক মামলাটি নেননি। তবে এ কারণে একজন বিচারককে আইনজীবীরা যেভাবে অকথ্য ভাষায় গালাগালসহ তাঁর সাথে আচরণ করেছে তা দুঃখজনক।
এই আচরণ আইন পরিপন্থী। এছাড়াও তিনি আইনজীবী কর্তৃক জেলা জজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করে বলেন, জেলা জজকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য সংবিধান পরিপন্থী। এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বাবুল বলেন, ‘আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত বন্ধ রেখে কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ নজিরবিহীন। জেলা ও দায়রা জজের ইন্ধনে এটি হয়েছে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো আইনজীবী মামলা লড়বেন না। জেলার নাসিরনগর উপজেলার ধরম-লের আক্কাস আলী জানান, তার ছেলে দীর্ঘদিন কারাগারে রয়েছে। আজকে তার জামিনের শুনানী ছিল। আইনজীবীদের আন্দোলনের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তা হয়নি। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরীকান্দী গ্রামের মন্নান মিয়া বলেন, কনকনে শীতের ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। এই শীতের রাতে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু হাজিরা দিতে পারলাম না। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, জেলা জজ মোহাম্মদ ফারুক বিচারকার্য পরিচালনার জন্য এজলাসে ওঠেন। এরপর দৈনন্দিন কার্যতালিকার নির্ধারিত মামলাগুলো শুনানির জন্য নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানবীর ভূঁইয়া, সম্পাদক (প্রশাসন) আক্কাস আলী, আইনজীবী জুবায়ের ইসলামসহ ১০ থেকে ১৫ জন আইনজীবী সেখানে যান। এ সময় আইনজীবীরা জেলা জজের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, চড়া গলায় গালিগালাজ করেন এবং এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। উল্লেখ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে গালাগাল ও তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণেরর ব্যাখ্যা জানতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে তলব করেছে হাইকোর্ট। আগামী ১৭ জানুয়ারি আদালতে হাজির হয়ে তাদের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি জে.বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ আদালত অবমাননার রুলসহ এ আদেশ জারি করেন।