ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
মুক্তিযুদ্ধ! শব্দটি এক অনবদ্য অবিচ্ছেদ্য শব্দ। মুক্তিযুদ্ধ শব্দের সাথে মিশে রয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের লাল তাজা রক্তের ঘ্রাণ, সম্ভ্রম হারা দুই লক্ষ মা বোনের ইতিহাস, আছে সাত কোটি থেকে ষোল কোটি মানুষের স্পন্দন। সেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অসংখ্য মানুষের মাঝে চিরায়ত ঘুমিয়ে আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের কোল্লাপাথর গ্রামের পাহাড় এলাকায় একটি টিলার উপরে ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কোল্লাপাথর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সমাধিতে রয়েছে সীমানা প্রাচীর, নিরাপত্তা দেয়াল, স্মৃতিফলক স্থাপন, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, সিঁড়ি, নান্দনিক রেস্টহাউজ, মসজিদ, হেলিপ্যাড, পুকুর ও বনায়ন ইত্যাদি। শহীদদের সমাধির জন্য সরকার সাড়ে বারো একর জমি অধিগ্রহণ করেছে যা বাংলাদেশের আর কোথাও এত বৃহৎ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি নেই। কুল্লাপাথর সমাধিস্থানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, চাঁদপুর, ময়মনসিংগ, ফরিদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাদের মূল ঠিকানা। এখানে দুজন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম, দুজন বীরপ্রতীক ও দুজন অজ্ঞাতসহ মোট ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের উপরেই লেখা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এবং ঠিকানা। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের, বিভিন্ন পেশার মানুষ হলেও বর্তমানে এক নামে পরিচিত, “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা”। ঐসব এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই আসেন তাদের আত্মীয়-স্বজন, আসেন সহযোদ্ধারা। নীরবে বসে থাকেন টিলার উপর স্বজনের সমাধির পাশে, আর অশ্রæ মোছেন গোপনে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকাটি ২নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সেক্টরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত। প্রায় প্রতিদিনই এখানে যুদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত সংলগ্ন কোল্লাপাথর গ্রামটি তখন মুক্তাঞ্চল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ২ং সেক্টর এলাকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাই শহীদ হয়েছেন। তাঁদের সকলের মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। যাদের উদ্ধার করা গেছে তাদের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে সীমান্তের দুদিকে যেখানেই ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেছে সেখানেই কবরস্থ করা হয়েছে। তাই সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করা যায়নি। কোল্লাপাথর গ্রামের আবদুল মান্নান তাঁর স্ত্রী-পুত্র ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করে এনে প্রয়োজনীয় গোসল, কাফন ও জানাজা দিয়ে তাঁর নিজের জমিতে সারিবদ্ধভাবে সমাহিত করেছেন। আশপাশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ সংগ্রহ করে গোসল ও কাফন দিয়ে স-সম্মানে নিজ হাতে দাফন করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন থেকে স্থানটির নামকরণ করা হয়েছিল “শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান”। এ কবরস্থানের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মান্নান এবং তাঁর স্ত্রী তাজাতুন্নেছা বেগম যুদ্ধোত্তরকালে প্রয়াত হয়েছেন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থানের এক পাশে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। পরবর্তী সময়ে তাদের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল করিম সমাধিস্থল তত্ত¡াবধানের দায়িত্ব পালন করেন।