রাজশাহী ব্যুরো
জমিতে আখ থাকলেও সুগার মিলে দিতে অনীহা দেখা গেছে চাষিদের। সুগার মিলের পরিবর্তে তারা মণ প্রতি ৫০-৬০ টাকা বেশি দরে গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে আখ বিক্রি করছেন। ফলে আখের অভাবে লক্ষ্য অর্জনের আগেই বন্ধ হয়ে গেল রাজশাহী সুগার মিলের আখ মাড়াই কার্যক্রম। জানা গেছে, সরকার গেল ১০ বছরে পাঁচ দফায় আখের দাম বাড়িয়েছে প্রতি মণে ৮০ টাকা। সর্বশেষ চলতি মৌসুমে (২০২২-২৩) আখের দাম প্রতি মণে বেড়েছে ৪০ টাকা। এ বছর ১৮০ টাকা মণ দরে আখ কিনেছে রাজশাহী সুগার মিল। মিল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২০২৩ মাড়াই মৌসুমে রাজশাহী সুগার মিল ৩৫ দিন চলার কথা থাকলেও ২১ দিনেই শেষ হয়েছে আখ মাড়াই কার্যক্রম।গতকাল শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) রাজশাহী সুগার মিলের এই মৌসুমের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ হয়েগেছে। আর তিন দিন পর জানা যাবে চিনি উৎপাদনের তথ্য। এছাড়া মিল বন্ধ হওয়ার পেছনে গুড় মাড়াইয়ে পাওয়ার ক্রাশার পরিচালনা করা ব্যবসায়ীদের দুষছেন সুগার মিল কর্তৃপক্ষ।
তাদের দাবি, রাজশাহী সুগার মিল জোন এলাকায় যে পরিমাণ আখ চাষ হয়েছিল তাতে ৩৫ দিনের বেশি মিল চলার কথা। কিন্তু তার আগেই আখের অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে মিল। এ বছর আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২১ দিনে মাড়াই হয়েছে ২৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এখনাে মাঠে ১৮ হাজার মেট্রিক টন আখ আছে। সেগুলো দিয়ে গুড় উৎপাদন করা হবে। এছাড়া পাওয়ার ক্রাশার দিয়ে আখ মাড়াইকারীরা চাষিদের থেকে ২২০-২৩০ টাকা মণ দরে আখ কিনছেন। আর রাজশাহী সুগার মিল চাষিদের থেকে ১৮০ টাকা দরে আখ কেনে।
সুগার মিলে আখের দাম কম পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। রাজশাহী সুগার মিল জোন এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়ার ক্রাশার চলে চারঘাট-বাঘায়। এই দুই উপজেলায় ১৩৫টি পাওয়ার ক্রাশার চলে বলে মিল কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ১৬টি পাওয়ার ক্রাশার জব্দ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাওয়ার ক্রাশার দিয়ে আখ মাড়াইয়ের দায়ে মামলা ও জরিমানার ঘটনাও ঘটেছে। একই অভিযোগে সর্বশেষ গত ২৫ নভেম্বর ১০ জনের নামে রাজশাহী কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নগরীর বুধপাড়া এলাকার আখচাষি মানিক আলী জানায়, গত বছর মিলে আখ দিয়ে টাকা তুলতে সমস্যা হয়েছিল। সেই বছর আখ বিক্রির কুপন পেতেও সমস্যা হয়েছিল। আখ চাষ করে ঘর থেকে টাকা দিতে হয়েছিল শ্রমিকদের। কিন্তু এই বছর আখ বিক্রির কিছু দিন পরেই টাকা পাওয়া গেছে।
আড়ানির আখচাষি আমানুল হক জানান, মিলে আখের দাম প্রতি মণ ১৮০ টাকা। তার মধ্যে কর্তন চার টাকা। কিন্তু মিলে আখ দিতে শ্রমিক দিয়ে কাটার খরচ, পরিবহন খরচ রয়েছে। কিন্তু গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে কাটা ও পরিবহন খরচ লাগে না। ব্যবসায়ীরা জমি থেকে আখ কিনে নিয়ে যায়। এছাড়া তারা প্রতি মণ আখের দাম দিচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। পাওয়ার ক্রাশারের মালিক ও গুড় ব্যবসায়ী বুলবুল হোসেন জানান, চাষিদের ৫ বিঘা জমিতে আখ থাকলে তিন বিঘা মিলে দেয়। আর দুই বিঘা বাইরে বিক্রি করে। তারা বিক্রি করে শ্রমিকদের টাকা দেয়। তবে মিলে আখের দাম কম। মিলে আখ দেওয়াতে এক ধরনের সুবিধা আছে। টাকা নিয়ে চিন্তা থাকে না। দেরিতে হলেও পাওয়া যায়। বাইরে আখ বিক্রি করলে অনেক সময় ব্যবসায়ীরা টাকা দিতে দেরি করেন, সমস্যা করেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে আড়ানিতে চিনি দিয়ে গুড় তৈরি হতো। এখন আর হয় না।
এক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আখ দিয়ে গুড় উৎপাদন হয়। অপর ব্যবসায়ী ফারুক জানান, তিনি নিজেও ২ বিঘা জমির আখ মিলে দিয়েছেন। এখনও এক বিঘা জমিতে আখ আছে। সেগুলো পাওয়ার ক্রাশার দিয়ে গুড় করাবেন। সুগার মিলে ২৬ হাজার টাকা ঋণ ছিল। সেই টাকা পরিশোধ করেছেন কিছু। কিন্তু মিলে আখ দিলে টাকা পেতে ১০-১২ দিন দেরি হয়। শ্রমিকদের টাকা এত দিন ফেলে রাখা যায় না। বাঘা ও আড়ানি সাব জোনের মাঠ উন্নয়ন সহকারীরা জানান, এই এলাকায় পাওয়ার ক্রাশার চলে। আমরা তাদের নিষেধ করি। কিন্তু তারা না শুনলে আমরা সুগার মিলে জানাই।
তারা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় পাওয়ার ক্রাশার জব্দ করার ঘটনাও ঘটেছে। রাজশাহী সুগার মিলের ব্যবস্থাপক (স¤প্রসারণ) নজরুল ইসলাম জানান, সবচেয়ে বেশি পাওয়ার ক্রাশার চলে চারঘাট-বাঘায়। এই দুই উপজেলায় ১৩৫টি পাওয়ার ক্রাশার চলে। বিভিন্ন সময় অভিযানে ১৬টি জব্দ করা হয়েছে। ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এছাড়া গেল ২৫ নভেম্বর ১০ জনের নামে রাজশাহী কোর্টে মামলা করা হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাবে। তার তিন দিন পরে জানা যাবে চিনি কতটুকু উৎপাদন হয়েছে তার তথ্য।