শ্রী দিপু চন্দ্র গোপ, রূপগঞ্জ,নারায়নগঞ্জ:
ক্রমেই বাড়ছে অনলাইন জুয়ার বিস্তার। করোনাকালীন পাঠদানের অযুহাতে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া মোবাইল এখন সর্বনাশার কারন। একদিকে জুয়ায় সর্বশান্ত হচ্ছে শ্রমিক, শিক্ষার্থীরা অন্যদিকে তরুণীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে কোরিয়ান পপ সঙ্গীত ভ্লগে বিটিএস আসক্তি। আর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অভিভাবক মহল। তবে ঘরোয়া এমন জুয়ার আসর বন্ধে কার্যত পদক্ষেপ নিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিংবা তরুণীদের আসক্তি থেকে থামাকে ব্যর্থ হচ্ছেন অভিভাবকমহল। এ চিত্র সারা দেশের হলেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শতাধিক স্পটে এখন জমজমাট। সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, জুয়ায় দুই পক্ষ চুক্তি করে হার জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায় সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে। পরিতাপের বিষয় হলো, এ জুয়া খেলে কেউ কেউ সর্বশান্ত হয়ে পড়েন। হারান সম্পদ, এমনকি নিজের জীবন। সরাসরি ভুক্তভোগী হয় পরিবার ও সমাজ। তাই জুয়া খেলা দেশের আইনে স্বীকৃত নয়। তবুও অতি লোভের আশায় প্রতিদিন নানা কৌশলে চলছে এ জুয়া।
অতীতে কার্ড দিয়ে, ক্যাসিনো বোর্ড বসিয়ে দলবেঁধে এ জুয়ার আসর বসলেও এখন ডিজিটাল পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছে জুয়ারীরা। যেখানেই ওয়াইফাই সংযোগ সেখানেই তরুণদের আড্ডা। আর আড্ডায় মেতে জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে বলে রয়েছে অভিযোগ। ফলে প্রশাসনের উদ্যোগ থাকা স্বত্তেও কোন কার্যত ফল পাচ্ছে না সমাজসচেতনরা। সলিমদ্দিন চৌধূরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গির মালুম বলেন, দেশের আইনে যেমন নিষিদ্ধ তেমনি ইসলাম ধর্মে জুয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আর এ নিষিদ্ধ কাজের প্রতি লোভী জুয়ারীদের ঝুঁক বেশি। আমরা চিন্তিত যে, কিছু শিক্ষার্থী বিট কয়েন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। সূত্র জানায়, বিভিন্ন কৌশলে জুয়ারীরা সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। এখন গোঁপনে জুয়াঘরে ও জুয়াঘরের এর বাইরে জুয়া খেলা হয়। এছাড়াও কার্ড,কয়েন, টস,পাশা, লুডু, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে জুয়াবাজি চলছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর হল ক্রীড়া অঙ্গন। ফুটবল, ক্রিকেট, বাসকেটবল ইত্যাদি খেলাতেও জুয়ারীরা বাজী খেলে থাকে।
এছাড়া এক জন আরেক জনের সাথে কোন বিষয়ে সত্য বা মিথ্যা হওয়া নিয়েও বাজী খেলে থাকে। চায়ের দোকানে খেলা দেখতে গিয়ে নিন্ম আয়ের শ্রমিকরাও জড়িয়ে গেছে এ জুয়ায়। রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডাক্তার নাজমুল আহমেদ বলেন, জুয়া ব্রেইনে মারাত্বক প্রভাব পরে,জুয়ারীরা চিন্তাগ্রস্থ ও অসহায়ত্ব অনুভব করে অসুস্থ হয়ে যায়।একসময় মাদক নেশায় জড়িয়ে যায়। অনেকে আতœহত্যাও করে। তাই জুয়ার থাবা থেকে সমাজপতিতের রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নারায়ণগঞ্জ জজকোর্টের এ্যাডভোকেট আক্তার্জ্জুমান বলেন, এখন আর জুয়া খেলা ক্লাবকেন্দ্রিক নেই। কিছুদিন আগেও যেখানে ক্যাসিনোতে বুথ হয়ে ছিল জুয়া খেলা। জুয়াড়িদের অনলাইনে সক্রিয় করা হচ্ছে গেমিং, বেটিং বা বাজি খেলার সাইটের নামে। সেখানে ক্যাসিনো খেলার মতোই বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেন্সি) মাধ্যমে জুয়া খেলা হয়। রূপগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, প্রায় ২০০ জুয়ার ক্ষেত্র শনাক্ত করে সেই সব ওয়েবসাইট লিংক বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও ভিন্ন কৌশলে বেড়েই চলেছে অনলাইন জুয়া। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে জুয়ার অ্যাপ। অনুমোদনহীন গেটওয়ের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া সাইট বা নতুন সাইট ব্রাউজ করে জুয়া খেলা চলছে। তবে এসব বন্ধে পুলিশের সংশ্লিষ্ট আইটি বিভাগ কাজ করছে। রূপগঞ্জেও ক্ষূদ্রভাবে ,বিচ্ছিন্নভাবে এমন থাকতে পারে। তবে তাদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলছে। উপযুক্ত তথ্য পেলে তড়িৎ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র জানায়, নজরদারির মাধ্যমে গেটওয়ে এবং প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে অনলাইন ক্যাসিনো আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। এ জন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান তাঁরা। রূপগঞ্জের ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার প্রায় শতাধিক চিহ্নিত আড্ডাস্থলে স্থানীয় তরুণ তরুনীদের মাঝে বিট কয়েন বিক্রি ও প্রতারণা করে আসছে একটি চক্র। তারা জুয়েল বিট কয়েন, ইথিরিয়াম, ইউএসডিটি নামে ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচা করেন। এদিকে, মোবাইল হাতে পেয়েই তরুণদের পাশাপাশি তরুনীরা হয়ে পড়েন ভার্চ্যুয়াল নেশায় আসক্ত। তারা বিটিএস নামীয় একটি পপ সঙ্গীন ভ্লগে সাইটের তরুণদের নিয়ে গবেষনায় লিপ্ত হয়ে যায়। অভিভাবক জানিয়েছেন, তার মেয়ে ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত বছর অনলাইনে ক্লাস করানোর কারনে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেই। আমরা জানতাম, গুগলে সার্চ করে সে লেখাপড়া করছে। কিন্তু বিশেষ কারনে মোবাইল সার্চ করে দেখা যায়, সে বিটিএস নামীয় গ্রুপের আসক্ত। তারা শিক্ষার্থীরা মিলে গ্রুপ খুলে সে গ্রুপে বিটিএস ভক্ত নামে ওই কোরিয়ান তরুণদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
তাদের অনেকেই কোরিয়ান ভাষা শিখে ওই তরুণদের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে নিজেরাই নানা প্রকাশ অশ্লিলকর্মে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাদের মাঝে সমকামিতার মতো ভয়াবহতা তৈরী হয়ে আছে। অপরএকটি সূত্র জানায়, বিটিএস ২০১০ সালে কোরিয়ান স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন তরুণ ট্রেইনি হিসেবে শুরু করলেও ১৩ সালে পূর্ণাঙ্গ সংগীত গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিটিএস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে বিটিএসের অসংখ্য ফ্যান যাদের বলা হয় বিটিএস আর্মি। ফলে দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশীয় সংস্কৃতি ছাড়িয়ে ভিনদেশী সংগীতের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। শুধু গান নয়, করছেন তাদের পোশাক ও চলনের অনুকরণও। কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্ছ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমেনা আক্তার লিপি বলেন, বিটিএস আমাদের দেশের কালচারের সাথে যায় না। ছেলেরা কেন মেয়েদের মতো আচরণ বা পোশাক পড়বে? আমার কাছে ওদেরকে দেখলেই বিকৃত মানসিকতার মনে হয়। এদেরকে ফলো করার তো কিছু নেই? ১০০ জন মানুষের মধ্যে দুজন বিটিএস ফ্যানকে আলাদা করে চেনা কোনো ব্যাপারই না। এসব তো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাজে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে তরুনীরা আসক্ত হচ্ছে বেশি। যা সমাজের জন্য হুমকী।