সেলিম শেখ, শ্রীপুর, গাজীপুর
গাজীপুরের শ্রীপুরে চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ ঘরে তুলতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। শ্রমিকের তুলনায় চাষীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় শ্রমের মুল্যও প্রায় দ্বিগুণ মূল্য গুনতে হচ্ছে কৃষককে। শ্রমিক সংকটে অনেকে বাধ্য হয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফসলের মাঠে ধান কাটছেন। অনেকে কৃষকরা আবার বাড়তি শ্রমমুল্য দিয়ে ক্ষেতের ধান কেটে বাড়িতে নিচ্ছেন। এতে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় লোকসান গুনতে হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। কৃষকেরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতেই ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ কাজে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সব প্রকার সার কীটনাশকের দামও বেড়েছে কয়েক দফায়। আগের তুলনায় ধান চাষে খরচ হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। জীবনযাত্রার মানের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবিকার তাগিদে শ্রমিকেরা ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। ধানকাটা এবং লাগানোর কাজ হয় শুধু মৌসুম এলেই। ধান কাটার শ্রমিকেরা ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নেয়ায় ধান কাটা শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। তাই মৌসুম আসলে এমন সংকটে পড়তে হয়। শ্রমিকেরা বলছেন, এক লিটার তেল কিনতে ২০০ টাকা লাগে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় আমাদের। তাই এক হাজার টাকা দৈনিক মজুরি না দিলে আমাদের পোষে না। শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামের কৃষক খালেদা আক্তার বলেন, কামলা (শ্রমিক) নিলে আমরা খেতে পারিনা, আর আমরা খেলে কামলা নিতে পারি না। পেটতো বাঁচাতে হবে। সরকার ধান কাটা, রোপণের জন্য মেশিন দেয়। কিন্তু আমরা এখনও এগুলো পাইনি। আমরা কী এসব পাব না?
একই গ্রামের কৃষক লাল মিয়া সরকার বলেন, পাকিতে (বিঘা) ১২ মন বা ১৪ মন ধান পাওয়া যায়। বর্গা করায় জমির মালিককে অর্ধেক দিতে হচ্ছে। ৬ বা ৭ মণ ধান পেলে খরচ বেশি হয়ে যায়। এখন কামলাও পাওয়া যায় না। এক হাজার টাকা রোজ বা প্রতি বিঘায় ৭ হাজার টাকা খরচে কামলা দিয়ে ধান কাটানোর ক্ষমতা আমাদের নাই। ধান কাটার জন্য সরকারিভাবে মেশিন পেলে আমাদের অনেক উপকার হতো। বরমী গ্রামের কৃষক সাহাব উদ্দিন চুক্তিতে জমি নিয়ে বোরো আবাদ করেছেন। ১০ মণ ধান পেলে জমির মালিককে দিতে হবে চার মণ। উৎপাদন খরচতো দূরের কথা আবাদ করে আটকে গিয়েছি। স্বামী-স্ত্রী মিলে বাধ্য হয়ে জমির ধান কেটে নিচ্ছি। উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সোনাকর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন জানান, অনেকেই খোঁজাখুজি করছেন। ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তিন বিঘা জমির ধান কাটতে দুইদিন খোঁজ করে শ্রমিক পয়েছেন। বিঘা প্রতি ৬ হাজার টাকায় শ্রমিক পেয়েছেন। ধান কাটা শ্রমিকের বাজার বিঘা প্রতি ৭ হাজার টাকা।
শ্রীপুর পৌরসভার উত্তরপাড়া এলাকার নাহিদ জানায়, সে স্থানীয় গাড়ারন মাদ্রাসার ছাত্র। প্রতি বিঘা (৩৫ শতক) সাড়ে ৬ হাজার টাকায় জমির ধান কাটার শ্রমিক না পাওয়ায় বাবা, ভাই মিলে ধান কাটছে। এতে তাদের সময় বেশি লাগছে। শ্রমিক পাওয়া গেলেও সিরিয়াল দিয়ে তিদনদিন পর পাওয়া যাচ্ছে।৭০ শতক জমিতে বোরো আবাদ করেছেন রাজাবাড়ী ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ী গ্রামের নাজিম উদ্দিন মাষ্টার। ৭ থেকে ৯’শ টাকা রোজ শ্রমিকের মজুরী। শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও মজুরী বেশি হওয়ায় পরিবার পরিজন, ভাই-ভাতিজা নিয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে ধান কাটছি। গোসিঙ্গা গ্রামের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাইম হোসেন বলেন, দু’দিন স্কুল বাদ দিয়ে মামাতো চাচাতো ভাইদের নিয়ে বাবার সাথে ৫৫ শতক জমির ধান কেটেছি। কুড়িগ্রাম থেকে আসা ধান কাটার শ্রমিক মোহাম্মদ আলী জানান, ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ধান কাটার কাজ করে দিনে এক হাজার থেকে ১২’শ টাকা পাওয়া যায়। উচ্চমুল্যের বাজারে চাষীরা মজুরী বেশি বললেও এ উপার্জনে আমাদের ধান কাটা শ্রমিকদের সংসার চলে না। ধান কাটা শ্রমিক রমজান আলী জানান, ধান কাটার পুরো মৌসুম শুরু হয়েছে। ধান কাটার শ্রমিক যদি থাকে ১’শ কৃষক থাকে তিন হাজার। বাজারে সকল কিছুর মুল্য বেশি। আমরাও শ্রমের বেশি মুল্য না নিলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলতে পারি না।
শ্রীপুর উপজেলা কৃষিসম্প্রসারণ কর্মকর্তা ইমতিয়াজ জাহান খান জানান, এ বছর শ্রীপুর উপজেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৬৫০ হেক্টর। এখনো পর্যন্ত পাকা ধানের ২৫ শতাংশ কাটা হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় প্রতি হেক্টরে সাড়ে তিন মেট্রিক টন করে ফলন হয়েছে। গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, গাজীপুর শিল্প অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে ধান কাটা শ্রমিকের সংকট রয়েছে। সরকারিভাবে সমন্বিত উপায়ে ধান কাটা যন্ত্রের ওপর ৫০ ভাগ ভর্তুকি দেওয়া হয়। গাজীপুরের আবাদি জমিগুলো খন্ড খন্ড। হাওড় অঞ্চলে একত্রিত জমি হওয়ায় সেখানে ধান কাটা যন্ত্র সমন্বিতভাবে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাওয়ার টিলার ভর্তুকির মাধ্যমে চাষের আওতায় এসেছে। তিনি বলেন, এবার বোরো আবাদে জেলা সদর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ উপজেলায় আশপাশের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫’শ হেক্টর জমির ফসল আগাম কাটতে হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার জেলায় সর্বমোট এক হাজার ৭’শ ৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি ধান কেটে ফেলা হয়েছে।