মোঃ রমজান আলী,রাজশাহী
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শহীদুল ইসলাম অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মুখটি সব সময় খোলায় থাকছে। যখন শ্বাস নিচ্ছেন তখন পুরো শরীরই নড়ে উঠছে। কিন্তু কথা বলা কিংবা ইশারা করার মতও শারিরে শক্তি তাঁর ছিলো না। ট্রলিতে ওঠানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন মাস্ক খোলা হলো। শহীদুল ইসলামের চোখ দুটি বের হবার উপক্রম। দ্রুতই তাঁকে ট্রলিতে উঠিয়ে আরেকটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাস্ক লাগানো হলো।রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ১৭ জুন বেলা ১১ টার দিকে এমন শ্বাসকষ্টই দেখা গেল শহিদুল ইসলামের। তার বাড়ি রাজশাহীর বাগমার উপজেলায়। রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স এসে থামছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করা হচ্ছে শহিদুল ইসলামের মতো রোগীদের। সবাই মনভরে একটু শ্বাস নিতে চাচ্ছেন। অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন মাস্কটি খুলে অন্য অক্সিজেন মাস্ক পরানোর মত সময়ও তাঁরা দিতে চাচ্ছেন না। একটু সময়ের জন্য অক্সিজেন মাস্ক খুললে তাঁরা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। শহিদুল ইসলাম কে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করে স্বজনেরা নিয়ে গেলেন করোনা ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে। সেখানে চিকিৎসকেরা জানালেন,তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। দ্রুতই আইসিইউতে নেয়া দরকার। কিন্তু হাসপাতালে তো আইসিইউ পেতে আগে থেকে অপেক্ষায় আছেন আরও ৪০ জন। তাই স্বজনেরা তাকে আবারও জরুরি বিভাগের সামনে আনলেন। চোখ মুছতে মুছতে তাঁর স্ত্রী রোকিয়া বেগম বললেন, তার স্বামীকে বাঁচাতে হলে ‘আইসিইউ দরকার। কতক্ষণ বাঁচবে তা তো জানি না। শেষ চেষ্টা হিসেবে আইসিইউতেই রাখতে চাই। তাই বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। একটু পরে জরুরি বিভাগের সামনে এসে দাঁড়াল আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স। এটি এসেছে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা থেকে। রোগীর নাম আমজাদ হোসেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে স্বজনেরা দ্রুত টিকিট কাটলেন। অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দ্রুত আমজাদকে নেয়া হলো জরুরি বিভাগে। সেখানে আবার মুখে লাগিয়ে দেয়া হলো অক্সিজেন মাস্ক। মিনিট দুয়েকের মত আমজাদের মুখে অক্সিজেন মাস্ক ছিলো না। আমজাদ ভুগছিলেন শ্বাসকষ্টে। আমজাদের বয়স ৫৫ এর বেশি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকেরা বলছেন, পঞ্চাশের বেশি বয়সী ব্যক্তিরাই বেশি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। জরুরি বিভাগেই অক্সিমিটারে মেপে দেখা যাচ্ছে, কারও অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৪০, কারও ৫০, কারও ৭০ কারও বা ৮০। একজন সুস্থ মানুষের স্যাচুরেশন ৯৪ এর উপরে থাকে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে আসছেন, তাঁদের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে করোনা পজিটিভ। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাঁদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর এসেছেন হাসপাতালে। তখন এই ফুসফুস ‘রিকভার’ করা চিকিৎসকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেকে মারা যাচ্ছেন। গত ১৬ জুন বুধবার দুপুর ১ টার দিকে ফিরোজা বেগম নামে এক বৃদ্ধাকে নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে আসে একটি অ্যাম্বুলেন্স। মুনিরার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। অ্যাম্বুলেন্সে শুয়েই মুনিরা একটু পর পর ‘ও মাগো, ও বাবা গো’ শব্দ করছিলেন। মাঝে মাঝে বলছিলেন ‘ও আল্লাহ’। মুনিরার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। নাকে লাগানো ছিলো অক্সিজেনের নল। স্বজনেরা অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন মেপে দেখলেন পঞ্চাশের নিচে। সঙ্গে থাকা মেয়ে হাতপাখার বাতাস দিয়ে চেষ্টা করছিলেন মায়ের যন্ত্রণা উপশমের। আর পুরুষেরা দৌড়াদৌড়ি করছিলেন ভর্তির জন্য। স্বজনরা জানান, ফিরোজা বেগমকে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসায় কোন উন্নতি হয়নি। তাই আনা হয়েছে রামেক হাসপাতাল। তাকে ভর্তির জন্য স্বজনেরা যখন ছোটাছুটি করছিলেন তখন জরুরি বিভাগের সামনে আসে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে শুয়ে ছিলেন রাজশাহী মহানগরীর দাশপাড়া মহল্লার বাসিন্দা শামসুন্নাহার। বয়স তাঁর আনুমানিক ৭৫ বছর। তাঁরও শ্বাসকষ্ট। চেষ্টা করছিলেন প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার। স্বজনেরা বলছিলেন, করোনা পজিটিভ। বাসায় চিকিৎসা চলছিল। হঠাৎ সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে শুরু হয় ঝিমুনি ও ঝাকুনি। তাই দেরি না করে এসেছেন হাসপাতালে। শামসুন্নাহার আর ফিরোজা বেগমকে আনা অ্যাম্বুলেন্স দুটি যখন দাঁড়িয়ে তখন আসে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স। এই অ্যাম্বুলেন্সে নওগাঁর আত্রাইয়ের রোগী জয়িতা রাণী। তাঁরও বয়স আনুমানিক ৭০ এর উপরে। অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ছিল ৬০ এর নিচে। রামেক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নয়ন ভৌমিক জানালেন, জয়িতা রাণী তাঁর আত্মীয়। করোনায় ফুসফুস প্রায় অকার্যকর। তিন দিন আগে তাঁকে রামেক হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভর্তি করা যায়নি। তাই ভর্তি করা হয়েছিল নগরীর বেসরকারি সিডিএম হাসপাতালে। সেখানে অক্সিজেন দেয়া হয় সিলিন্ডারে। জয়িতা রাণীর মতো তীব্র শ্বাসকষ্টে থাকা রোগীদের এতে কোন লাভ হয় না। তাই আবার জয়িতাকে আনা হয়েছে রামেক হাসপাতালে। এই হাসপাতালে পাইপের মাধ্যমে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। ডা. নয়ন যখন কথা বলছিলেন, তখনও জয়িতার রাণীর তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। চেষ্টা করছিলেন শ্বাস নেয়ার। গতকাল মঙ্গলবার (১৫ জুন) সকাল সাড়ে ১০টায় জরুরি বিভাগে আসে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল গ্রামের রোগী মো. বেলালুজ্জামান (৬৬)। মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক। শ্যালক মো. আব্দুল্লাহ অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন মেপে দেখলেন ৬২। কয়েকজন ছোটাছুটি করছিলেন ভর্তির জন্য। প্রায় ৪০ মিনিট পর বেলালুজ্জামানের ভর্তি হলো। ওয়ার্ডে নেবার পর বেলালুজ্জামান মারা গেলেন। স্বজনদের অভিযোগ, ভর্তি করতেই অনেক সময় লাগছে। বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘আমাদের এখানে বেডের চেয়ে রোগী বেশি। রোগী এনেই স্বজনেরা বলছেন, বাসায় অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ছিল ৯০ এর নিচে। আমরাও মেপে দেখছি। একটু পর্যবেক্ষণ করছি। সে কারণে ভর্তিতে সময় একটু বেশি লাগছে। অক্সিজেন স্বাভাবিক আছে এমন রোগীকে ভর্তি নিলে তো জায়গা দেয়া যাবে না। তবে, গত ২৪ ঘণ্টায় যাঁরা এসেছে, আমরা সবাইকে ভর্তি নিয়েছি। কাউকে ফিরিয়ে দেইনি। এ জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হচ্ছে। তবে যত দ্রুত রোগী বাড়ছে তত দ্রুত সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরাই শ্বাসকষ্টে ছটফট করছেন। তারা প্রাণখুলে শ্বাস নিতে চাচ্ছেন। কয়েকদিন ধরে অল্পবয়স্করাও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনজন মারা গেছেন যাদের বয়স ২১ থেকে ৩০ এর মধ্যে। আর ২৪ ঘণ্টায় মোট মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে সাতজনের বয়স ৬১ বছরের উপরে। ভর্তির পর সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন দিয়ে রোগীদের অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত অক্সিজেনও আছে। কিন্তু করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে রোগী ভর্তির আগেই ফুসফুস এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে যে কাউকে কাউকে বাঁচানো যাচ্ছে না।