এসএম রাজু আহমেদ:
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল কেবলস ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবিএম এরশাদ হোসেন রাজধানীতে বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারার্স কোম্পানি সহ অন্তত ডজনখানেক সংগঠনের ছোট-বড় পদ-পদবী ধারণ করে বহুমুখী প্রতারণায় লিপ্ত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৈদ্যুতিক ক্যাবলস উৎপাদনের ন্যূনতম জ্ঞান বা দক্ষতা তাহার না থাকলেও মেসার্স আশা ক্যাবলস নামক একটি বৈদ্যুতিক ক্যাবলস উৎপাদন কোম্পানি সহ ডালাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। শুধুমাত্র একটি ট্রেড লাইসেন্সের মধ্যেই এই কোম্পানি দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও বাস্তবে এই প্রতিষ্ঠান দুটির অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া ডালাস ট্যূরস এন্ড ট্রাভেলস নামীয় ব্যানারে চলছে তার মানবপাচার ব্যবসা। এই প্রতিষ্ঠানের বৈধ কোন লাইসেন্স না থাকলেও লাইসেন্স প্রাপ্ত ১৩৫টি কোম্পানিকে ইজারা নিয়েছেন বলে দাবি করেন প্রতারক এরশাদ।
আবার ঢাকা বৈদ্যুতিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬৯ শতাংশ জমি বিক্রির ১কোটি ৭০ লাখ টাকা সহ সমিতির ফান্ডের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে ছিলেন এই প্রতারক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালে এবিএম এরশাদ হোসেন মের্সাস আশা কেবলসের নামে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিরতারা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেন। অথচ এই উপজেলার সাথে এরশাদের বাস্তবিক কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এরশাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। সে জীবনে কখনোই বিরতারা ইউনিয়ন পরিষদে যায় নাই। আর আশা ক্যাবলসের ফ্যাক্টরি টাঙ্গাইলের কোন জায়গায় অবস্থিত ছিল সেটাও বলতে পারেনা। মেসার্স আশা ক্যাবলস ফ্যাক্টরিটি কোথায় আছে এমন প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ বলেন, আমার ফ্যাক্টরি বাংলাদেশর যেকোনো প্রান্তে আছে, এতে তোর কি সমস্যা। তোরে সাংবাদিক বানাইতে কে?। এসময় তিনি উত্তেজিত হয়ে মন্ত্রী-এমপি, এসি-ডিসি-সচিব, র্যাব-পুলিশ সহ নামিদামি নানা লোকজনের কথা বলে এ প্রতিবেদককে হুংকার দিয়ে থাকেন। তবে আশা ক্যাবলস নামের এই ট্রেড লাইসেন্সটির মাধ্যমে এবিএম এরশাদ হোসেন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মালিক সেজে বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারার্স সংগঠনের পদ-পদবী বাগিয়ে নিয়েছেন। কোথাও সভাপতি, কোথাও সম্পাদকসহ নানা সংগঠনে নানা পদে যুক্ত হয়েছেন। আবার কোন সংগঠনের পদ-পদবি কৌশলে দখল করে নিয়েছে। মুলত প্রতারনার টার্গেট পূরণ করতে বিভিন্ন সংগঠনের পদপদবি ধারণ করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কোন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ দখলে নিতে পারলেই ঐ সংগঠনকে তছনছ করে সটকে পড়েন।যার জলন্ত উদাহরণ ঢাকা বৈদ্যুতিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিঃ।
সুত্র জানায়, ১৫৭ জন সদস্য নিয়ে ১৯৯৬ সালে ঢাকা বৈদ্যুতিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিঃ প্রতিষ্ঠা করেন এবিএম এরশাদ হোসেন। সেই অনুযায়ী তিনিই প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। সমিতির রেজিঃ নং-৮৬, ঠিকানা-১৩৪/১ নবাবপুর রোড, সুত্রাপুর, ঢাকা। সভাপতি হিসেবে এবিএম এরশাদ হোসেন, সমিতির তহবিল থেকে ২২মে-২০০০ইং তারিখে সাভার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ৭৫৩৯নং সাব- কবলা দলিল মূলে ঢাকা বৈদ্যুতিক ব্যবসায়ী সমিতি লিঃ ঠিকানা-১২৮ নবাবপুর রোড, নুর ইলেকট্রিক, মার্কেট ঢাকা এর নামে জামাল উদ্দিন গংদের নিকট থেকে ৬৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার জন্য উক্ত জমিটি তিনি সমবায় কর্তৃপক্ষের হিসাব বিবরণীর বাহিরে রাখেন। যা সমিতির ২০০২/৩ ও ২০০৩/৪ অর্থবছরের অডিট রিপোর্টে উঠে আসে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে প্রাপ্ত এ রিপোর্টে দেখা গেছে, উক্ত জমির ব্যাপারে কোন তথ্য-রেকর্ড সমবায় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার হয়নি। কিন্তু জমিটি সমিতির নামে রেজিস্ট্রিকৃত হওয়ায় সমবায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়পত্র ছাড়াই কোন ভাবেই অন্যত্র সাব রেজিস্ট্রি দলিল মুলে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
এ কারণে এরশাদ জাল-জালিয়াতি মূলক কাগজপত্র তৈরি করিয়া ২২জানুয়ারী-২০১৩ তারিখে সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে করে ১৪৫৫ নং দলিল মূলে সমিতির সদস্য মোজাম্মেল হকের নিকট অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে দেন। অতপর এরশাদ সমিতির সদস্যদের অজান্তে জমি বিক্রির ১ কোটি ৭০লক্ষ টাকা এবং সমিতির তহবিল থেকে গ্রহণকৃত ঋণ বাবদ আরো ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়েন। তবে মজার ব্যাপার হলো ২০০৪ সালের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী সমিতির মোট ফাÐের ৯০ ভাগই এরশাদের কাছে পাওনা। এরশাদ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রথম দুই বছর ছাড়া বাকী ১৩ বছরই মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি হিসেবে বহাল থেকে ২৫/৯/২০১১ তারিখে ঢাকা মেট্টোথানা সুত্রাপুর এর সমবায় অফিসার মোঃ হারুনুর রশিদের নিকট সমিতির দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন । কিন্তু সমবায় কর্তৃপক্ষের এই কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি/প্রশাসক পদে বহাল থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে অর্থাৎ দুই বছর পূর্বে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া সভাপতি এবিএম এরশাদ হোসেন কিভাবে ঐ জমিটি রেজিস্ট্রি দলিল মূলে বিক্রি করলেন। যেখানে সমবায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পত্র ও সমিতির সাধারণ সভার কার্যবিবরণী ছাড়া কোনো ভাবেই জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব নয়। সুতরাং এই বিষয়টি আমলে নিলেই এরশাদের জাল-জালিয়াতির প্রমান পাওয়া যাবে। কারন সমবায় অধিদপ্তরের নথিতে এই জমি সংক্রান্ত কোন রেকর্ড/ কাগজপত্র জমা নেই।
এদিকে প্রতারণার পেশাকে শক্তিশালী করতে এরশাদ শুধুমাত্র একটি ট্রেড লাইসেন্স দ্বারা বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য পদ-পদবী ভাগিয়ে নিয়ে প্রতারণার কৌশলকে শক্তিশালী করেন। সুতরাং মেসার্স আশা কেবলসের নামে যেই ট্রেড লাইসেন্স গুলো রয়েছে সেগুলোর ধারাবাহিকভাবে নবায়ন করা হয়েছে কিনা, এই লাইসেন্স বা প্রতিষ্ঠানের নামে কত টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স প্রতিশোধ করা হয়েছে সেই অনুযায়ী ভ্যাটের রশিদ গুলো পরীক্ষা করলেই এরশাদের প্রতারণা ধরা সম্ভব হবে। এসব বিষয় নিয়ে এরশাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যকে নিজের ফুফাতো ভাই দাবী করে সাংবাদিকদেরকের বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে তাকে চিঠি পাঠিয়ে ডেকে নেয়। ভুয়া লোক হলে মন্ত্রণালয় তাকে ডাকতো নাকি। বানিজ্য মন্ত্রনালয় থেকে আপনাকে শোকোজ করেছে এ এমন প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ বলেন, এসব শোকোজ-টোকোজ কিছুই না, পুরাতন একটা চিঠি, এটাকে ঘষামাজা করে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠিতে আমার কিছুই করতে পারবে না। আর এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের পরিচয় দিয়ে এবিএম এরশাদ হোসেন হুমকি স্বরূপ কথাবার্তা বলে সাংবাদিকদের স্তব্দ করার চেষ্টা করেন। এরশাদ নিজেকে বিএসটিআই’র নীতি-নির্ধারণী স্ট্যন্ডিং কমিটির সদস্য বলে দাবি করেন। কিন্তু নিজের কোম্পানী মেসার্স আশা কেবলস এর নামেই তো বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নাই। এরশাদ মুখে যত কথাই বলেন না কেন তার স্বপক্ষে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। কোন তদন্তকারী সংস্থা এরশাদের এসব প্রতারণার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তদন্ত করলে শুধুমাত্র একটি অনিয়মিত ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্য কিছুই খুঁজে পাবেনা