*১৬ টাকার খতিয়ান তুলতে লাগে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা
*নামজারীতে ১১৭০ টাকার পরিবর্তে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়
চান্দিনা ভিটি, হাটবাজার, জলভূমি, পুকুর ইজারায় ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য
মো.বশির হোসেন
স্মার্ট ভূমি সেবায় ভূমি মন্ত্রনালয়। এই শ্লোগান নিয়ে শুরু হয়েছে ভূমি সেবা সপ্তাহ ২০২৩। সরকার ভূমি সেবা জনগনের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহন করলেও ভূমি অফিসের কিছু অসাধূ দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে কাঙ্খিত সুফল মিলছে না। দূর্নীতি যেন কোন ভাবেই পিছু ছাড়ছে না এই মন্ত্রণালয়কে। বিগত কয়েক বছরে ভূমি মন্ত্রনালয়ের বেশ কিছু উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ারমত। এর মধ্যে নামজারী বা জমাখারিজকে আধুনিকায়ন করার জন্য ই-মিউটেশন ব্যবস্থা এবং অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর সেবা চালু। এর ফলে পৃথিবীর যেকোন জায়গায় বসে অনলাইনে নামজারী আবেদন করা যাচ্ছে। এছাড়াও জমির খাজনা ঘরে বসে দেওয়ার জন্য সরকার এলট্রি ট্রাক্স নামে আরেকটি অনলাইন সেবা চালু করেছে। সম্প্রতি সরকার নামজারী বা জমা-খারিজের ফি তথা ডিসিআর ফি অনলাইনে প্রদান করার জন্য অক্টোবর মাস থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও দলিল রেজিষ্ট্রি হওয়ার সাথে সাথে যাতে অটোমেটিক ভাবেই নামজারী হয়ে যায় সে উদ্যোগও ইতিমধ্যে সরকার গ্রহণ করেছে। যার সুফল খুব তাড়াতাড়ি জনগন ভোগ করবেন। এর ফলে হয়রানি এবং দূর্নীতি যেমন কমবে তেমনি সময়ও বাঁচবে। সাধারনত ইউনিয়ন ভূমি অফিসই জনগনের সেবা প্রদানের প্রানকেন্দ্র।
কিন্তু এসব অফিসের কর্মকর্তারা কোন ভাবেই ভূমি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে খুশি নন। এর মূল কারণ তাদের ঘুষ বানিজ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়,একটি সাধারণ নামজারী বা জমাখারিজ কয়েক ধাপ পেরিয়ে তারপর সম্পন্ন হয়। ধাপ গুলোর মধ্যে তহসিলদারের রির্পোট, সার্ভেয়ারের মতামত, কানুনগোর মতামত এসিল্যান্ডের অনুমতি এবং সর্বশেষ নাজিরের মাধ্যমে ডিসিআর এর কপি প্রদান। ধাপগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই দূর্নীতিবাজরা উকিমেরে থাকেন নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। ই-মিউটেশন চালু হলেও ধাপগুলোকে ঠিকই আগেরমত অতিক্রম করে তারপর সম্পূর্ন হতে হয়। আর এই কাজ সম্পূর্ন হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই ইউনিয়ন তহসিলদারের সরেজপরিদর্শন প্রতিবেদন গুরত্বপূর্ন।
এই প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য প্রতিটি সাধারন নামজারীতে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার চুক্তি করতে হয়। চাহিদামত টাকা না দিলে বিভিন্ন ওজুহাতে নামজারী প্রতিবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। আদালতের ডিগ্রি বা নিলাম সূত্রে নামজারীতে মালিকানার শরিক বেশি হলে চাহিদা বাড়ে কয়েকগুন যা কখনো লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর বাহিরেও রয়েছে জাল কাগজপত্র দিয়ে একজনের জমি আরেকজনকে নামজারী করে দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়াও চান্দিনা ভিটি, হাটবাজার, জলভ‚মি, পুকুর ইজারা এবং খাস জমি বন্দোবস্ততেও রয়েছে ব্যাপক ঘুষ বানিজ্য। অভিযোগ রয়েছে প্রকৃত ব্যক্তিদের মাঝে বরাদ্ধ না দিয়ে ক্ষমতাশীন ও বিক্তবানদের বরাদ্ধ দেওয়ার।
এখানেই দূর্নীতির শেষ নয় সাধারন দাখিলা বা ভূমি উন্নয়ন কর দিতে গেলেও অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় ইউনিয়ন তহসিলদারকে। এছাড়া তহসিল অফিসের একটি পর্চা বা খতিয়ান এর নকল তুলতে সরকারি কোর্ট ফি ২ টাকা এবং সাধারন ফি বাবদ ১১ টাকা মোট ১৩ টাকা হলেও প্রকৃত পক্ষে একটি খতিয়ান তুলতে দিতে হয় ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর এই টাকার পুরোটাই যায় তহসিলদার এবং অফিস সহকারির পকেটে। সরকার এ সকল দূর্নীতি রোধে ভ‚মি সংক্রান্ত সেবাকে অনলাইনের মাধ্যমে জনগনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেওয়ার জন্য সর্বাত্বক চেষ্টা করলেও তাতে খুশি নন দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। তারা হাতে কলমের কাজেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই আবার কম্পিউটার চালাতে জানেন না। সাধারন এলট্রি ট্যাক্স এন্টিতেও তাদের মারাত্বক সব ভুল ধরা পরছে। ভুলগুলোর ব্যাপারে অভিযোগ দিলে তাতে কর্ণপাত করেন না তহসিলদাররা।
দেশের ৪৫৭১ টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের চিত্র প্রায় একই । বিভিন্ন ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা একাধিক সেবাপ্রার্থির সাথে কথা বলে জানা যায় তারা ভূমি অফিসের কোন কাজই ঘুষ ছাড়া করতে পারেনা। সাধারন নামজারীতে ২৮ দিনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তহসিলদাররা থোরাই কেয়ার করছেন সে নিয়মকে। অভিযোগ আছে যে বেশি টাকা দিতে পারে তার প্রতিবেদন আগে হয়। এছাড়াও ডিসিআর এর কপি নিতে হলেও নাজিরকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। মিসকেস রুজু করতে গেলে এসিল্যান্ডের প্রধান সহকারী বা নাজিরকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। সরকার উন্নত সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলেও অনেক কর্মকর্তাই নিজেদের ঘুষ বানিজ্য থেকে দূরে রাখতে পারছেন না।
অনেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) চাকুরীর শুরুতেই নামজারী প্রতি তার হাদিয়া নির্ধারন করে দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক তহসিলদারের সাথে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদেরমতে নামজারীর টাকার ভাগ উপজেলা অফিসের সকল কর্মকর্তাকেই দিতে হয়। সার্ভেয়ার,কানুনগো,নাজির এবং এসিল্যান্ড সকলের নামজারী প্রতি হাদিয়া নির্ধারন করা আছ্। টাকা না পেলে সার্ভেয়ার এবং কানুনগো তার প্রতিবেদনে সই করেন না।এ বিষয়ে মনির হোসেন নামের একজন ভুক্তভোগি জানান সাভারের মশুরী খোলা মৌজায় ৩ বন্ধু মিলে ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করি। এরপর নামজারীর জন্য দিলে ৩ জনের পৃথক নামজারীর জন্য ৮ হাজার টাকা করে প্রত্যেককে দিতে হয়েছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে ফরহাদ হোসেন নামের এক ভুক্তভোগি জানান ৭ মাস আসে আমার নামে মিসকেস হয়। আমি উপস্থিত হয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বারবর আমার লিখি আপত্তি এবং বনর্না প্রদান করি। সব প্রতিবেদন আমার পক্ষে থাকা সত্যেও আদেশের জন্য আজ ৭ মাস দ্বারে,দ্বাওে ঘুরতেছি। যদি টাকা দিতাম তাহলে অনেক আগেই আদেশের কপি পেয়ে যেতাম।
দূর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেন,দূর্নীতি রোধ করতে হলে জনগনকে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থা সর্ম্পকে সচেতন করতে হবে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বদলি কোন সমাধান না বদলির মাধ্যমে নতুন জায়গায় গিয়েও তারা একই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে প্রচলিত আইনে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলে তারা দূর্নীতি করতে সাহস করবে না। এছাড়া পুরো ভূমি ব্যবস্থা ডিজিটাল সিষ্টেমের আওতায় আনতে পারলে দূর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার ভূমির দূর্নীতি প্রতিরোধে চেষ্টা করে যাচ্ছে এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। একই সাথে সরকারকে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে ভূমি সচিব মোঃ খলিলুর রহমান বলেন,স্মার্ট ভূমি সেবা জনগনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে শতভাগ ই নামজারী এবং অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর সেবা চালু হয়েছে। ভূমিঅফিসে না গিয়ে জনগন যাতে ঘরে বসে তার কাঙ্খিত সেবা পায় সেজন্য বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অটোমেটিক ই নামজারী বাস্তবায়ন হলে জনগন ঘরে বসে দূর্নীতিমুক্ত ভূমি সেবা গ্রহন করতে পারবেন। এছাড়াও নতুন ভূমি আইনের খসড়া চুড়ান্ত করা হয়েছে। আইনটি পাশ হলে ভ‚মি সংক্রান্ত অপরাধ এবং দূর্নীতি কমবে । তাই এবারের ভূমি সেবায় আমাদের শ্লোগান স্মার্ট ভূমি সেবায় ভূমি মন্ত্রণালয়।