পানি সম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আড়িয়াল বিলকে হয় একটা জলাভূমি কেন্দ্রিক সংরক্ষিত এলাকা অথবা বিশেষ জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আড়িয়াল বিলকে আমাদেরকে একটা জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেলে ঢাকায় পানি ভবনের সম্মেলন কক্ষে ‘আড়িয়ল বিল এলাকার জীবনযাত্রার মান এবং পানি ও ভূমি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রকল্পের ফলাফলের উপর অনুষ্ঠিত এক জাতীয় কর্মশালায় সম্মানিত অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, একটা প্রটেকশন স্ট্যাটাস বা সংরক্ষিত মর্যাদা আড়িয়াল বিলকে দিতে হবে, তা না দেয়া পর্যন্ত এই বিলের ধ্বংসযজ্ঞটা আমরা কমাতে পারবো না। এছাড়া তিনি বলেন, বেলাই বিল এবং চলন বিলকেও জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে।
পানি সম্পদ উপদেষ্টা বলেন, নদ-নদীকে নষ্ট করে আমরা উন্নয়ন করতে পারিনা। দরকার হলে আমরা অনেক দূর ঘুরে যাব কিন্তু খাল বা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে যাওয়ার যে টেন্ডেন্সি বা প্রবণতা এ জায়গা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান কর্মশালায় উপস্থিত মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক-কে আড়িয়াল বিলের ভিতরে মৎস্য চাষের জন্য খালের ওপর বেআইনিভাবে নির্মিত অপরিকল্পিত মাটির বাঁধগুলো তালিকা করে অবিলম্বে অপসারণ করার নির্দেশ দেন।
উপদেষ্টা বলেন, যে বাঁধগুলো লোকজন চলাচলের জন্য করেছে, ওখানে বাঁধগুলো কেটে দিয়ে খালের ওপর বাঁশের পথ করে দিতে হবে।
এছাড়া আড়িয়াল বিলের ভিতরে খালের ওপর দেয়া অবৈধ মাটির বাঁধ অপসারণ করে মানুষের চলাচলের জন্য কিছু ছোট ছোট সেতু অল্প সময়ের মধ্যে নির্মাণ করে দেয়ার জন্য সড়ক বিভাগকে আমরা অনুরোধ করব। তিনি বলেন, একটা খালের উপরে সেতু করা খুব একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার না।
উপদেষ্টা আড়িয়াল বিলে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত ০৮ টা বন্ধ খাল যেগুলো ক্লোজার করে রাখা হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করে খুলে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সমন্বিতভাবে কাজ করা নির্দেশনা প্রদান করেন।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, আড়িয়াল বিল এলাকার গ্রাম পর্যায়ে, মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় জনগণের মতামত নিয়ে আমরা আড়িয়াল বিল সম্পর্কে একটা বিস্তারিত প্রকল্প গ্রহণ করব।
পানি সম্পদ উপদেষ্টা সংশ্লিষ্টদের কর্মকর্তাদের আগামী এক মাসের মধ্যে আড়িয়াল বিল সম্পর্কে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন এবং সেই সাথে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।
উপদেষ্টা আরও বলেন, আড়িয়াল বিলকে আমরা একটা প্রটেক্টেড এরিয়ার মর্যাদা দিয়ে, দাগ- খতিয়ান ধরে আমরা একটা গেজেট করে দেব। এই কাজটা আমাদের সময় আমরা করতে পারবো।
পানি সম্পদ উপদেষ্টা বলেন, আমরা একটা ফাস্ট ফেজ এ আড়িয়াল বিলে যেখানে যেখানে পানির প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে, সেই বাঁধাগুলো আমরা অপসারণ করবো এবং এটা আমরা আমাদের সময়ে করে দিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আড়িয়াল বিলে কিছুটা ড্রেজিং করার দরকার হলে তাও করা সম্ভব। বিলের ৫৩৯০ হেক্টরের মধ্যে সরকারের খাস খতিয়ানে থাকা ৭১.৭৭ হেক্টরকে বিশেষ জীববৈচিত্র এলাকা বা সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা যেতে পারে বলে উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্য উল্লেখ করেন।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আড়িয়াল বিল রক্ষার মডেলটা আমরা বেলায বিল এবং চলন বিলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করব। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী হই যে এই বিলটি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করতে পারবো।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে পানির প্রবাহ,অবৈধ জিনিস সরিয়ে দেয়া, আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস গাছ সরিয়ে দেয়া এবং জমির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার প্রক্রিয়াটা শুরু করা আমাদের এখন অনেক জরুরী।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আড়িয়ল বিলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় গরীব কৃষক যেন উপকৃত হয় সে বিষয়টি আমাদের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আড়িয়াল বিল এলাকায় পানির মাধ্যমে নদীমাতৃক যোগাযোগ কিভাবে গড়ে তোলা যায় এ বিষয়ে আমাদেরকে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, আড়িয়াল বিলে পরিবেশ রক্ষা করে মানুষ এবং প্রকৃতির উপকারে আসবে সেই পদক্ষেপ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য রাখেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল হাসান। এছাড়া স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান।
দিনব্যাপী কর্মশালায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ; স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক-সহ শ্রীনগর, দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ ও আড়িয়াল বিল সুরক্ষা কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কর্মশালার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন আইডব্লিউএম এর সেচ, পানি ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক গৌতম চন্দ্র মৃধা।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আড়িয়াল বিলের ওপর দলীয় কার্যক্রম পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন।