বগুড়া প্রতিনিধিঃ
কখনো কখনো ১০০ মিটার রাস্তা যেতে সময় লেগে যায় ৩০-৪০ মিনিট। চরম এই অসহ্য জ্যামের শহরে বসবাস করা এখানকার মানুষের নাভিশ্বাসে পরিনত হয়েছে। উপায় না পেয়ে কখনো কখনো নির্দিষ্ট সময়ে পৌছার তাগিতে দুই-এক কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেটেই পাড়ি দিতে হচ্ছে চাকরিজীবীদের। শ্রমজীবি মানুষদেরকেও পরতে হয়েছে চরম বিরম্বনায়। তবে এই জ্যামের আসল কারনগুলো কেউ নিজেদের কাধেঁ নিতে চায়না। কারন প্রশাসনের গাফিলতি, রাজনৈতিক নেতাদের পকেট ভাড়ি, মালিক পক্ষের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার, চালক শ্রমিকদের পরিবার চালানো, রিকশা ও অটো রিকশা চালকদের পেটের দায়ে ছুটে চলার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয়েছে চলাচলের অনুপযোগী এই চরম ভোগান্তির জ্যামের শহর। অর্থাৎ প্রশাসনের ম্যানেজ প্রক্রিয়া ও আইনের আওতায় না নেয়াটাই মূল কারন।
জ্যামের কারনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে স্কুল কলেজের বাসগুলোর বেপরোয়া চলাচল, কুরিয়ার সার্ভিসের মস্তবড়-বড় গাড়ি, প্রয়োজনের চেয়ে হাজার হাজার বেশি রিক্সা ও ইজিবাইক, রাস্তার পাশ দিয়ে যত্র-তত্র পার্কিং, ফুটপাতে অসংখ্যা দোকান, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, শহরের সবথেকে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণস্থানে দুরপাল্লার বাসটার্মিনাল, করতোয়া গেটলক নামের বাস গাড়ির দৌরাত্বসহ আরো নানা ধরনের অবৈধ ও অনিয়মের কারনেই বগুড়া শহরে এই প্রচন্ড জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে এই জ্যামের জটিলতা। এছাড়া সবথেকে উল্লেখযোগ্য কারন হিসেবে বলা চলে শহরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দিয়ে রয়েছে তিনটি রেল ক্রসিং।
প্রতিদিন অন্তত ১৬টি ট্রেন চলচল করে থাকে শহরের মাঝবরাবর দিয়ে বেয়ে যাওয়া রেললাইন দিয়ে। একারনে প্রতি ঘন্টায় সাতমাথা এলাকা থেকে দত্তবাড়ি পর্যন্ত জ্যাম লেগেই থাকে। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় স্কুল বাসগুলোর দৌড়াত্ব। সারাদিন প্রায় অর্ধশত বাসের নিয়ন্ত্রনে থাকে বগুড়া শহর। বনানী থেকে মাটিডালি ও তিনমাথা রেল গেট থেকে বউবাজার পর্যন্ত এসব স্কুল বাসের চাপেই মূলত শহরের জ্যাম। এছাড়া করতোয়া গেটলক বাস, রেল ষ্টেশন এলাকা থেকে সাতমাথা হয়ে কলোনী, বনানী হয়ে শেরপুর উপজেলায় যায়। কিছুক্ষন পরপর ছাড়া হয় বাসগুলো। এতে একটা পর একটা লেগেই থাকে। সাতমাথা থেকে ঠনঠনিয়া পর্যন্ত জ্যামের মূল কারন এই করতোয়া গেটলক। রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস। এই গাড়িগুলোও জ্যামের উল্লেখযোগ্য কারন।
গাড়িগুলো ইউটার্ন নিতে প্রতিনিয়তই জ্যামের সৃষ্টি হয়। আবার নিয়মনিতী না মেনে শহরের মধ্যেও ঢুকে পরে এসব কুরিয়ারের গাড়ি। আবার সাতমাথা এলাকাতেই রয়েছে বিআরটিসির টার্মিনাল। জ্যাম স…ষ্টিতে বিশেষ এই গাড়িগুলোর ভুমিকাও কম নয়। বগুড়া শহরের আয়তন অনুযায়ী রিকশা ও ইজিবাই যে পরিমান চলার কথা, তার চেয়ে অন্তত ২০গুন বেশি চলাচল করে এই শহরে। শহরের সবথেকে জরুরী এলাকা হল ঠনঠনিয়া। কারন এখানে রয়েছে ফায়ারসার্ভিস, মোহাম্মাদআলী হাসপাতাল, পপুলার ডায়গনোষ্টিক সেন্টার, ডক্টরস ক্লিনিকসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ অফিস এছাড়া পাশেই রয়েছে পুলিশ লাইনস্, র্যাব- ১২ ক্যাম্পসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্তু এমন জরুরী স্থানেই রয়েছে ঠনঠনিয়া বাস টার্মিনাল। যে কারনে সকাল থেকে শুরু করে রাত ১১টা পর্যন্ত সর্বক্ষন জ্যাম লেগেই থাকে। এতে করে প্রায়ই ফায়ার সার্ভিসের জরুরী গাড়ি ও রোগিবাহী এ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ ও র্যাবের জরুরী গাড়ি চলাচলে চরম বিরম্বনায় পরতে হয় কিন্তু কখনোই প্রশাসনকে এসব নিয়ন্ত্রনে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সচেতন মহলের দাবি ৫০ সিটের গাড়ির পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০ সিটের গাড়ি ব্যবহার, ঠনঠনিয়া বাস টার্মিনাল শহরের বাহিরে করতোয়া গেটলক গাড়ির টার্মিনাল ও চলাচল শহরের বাহিরে নেয়া, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বড় সকল গাড়ি শহরের ভেতরে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া। রিকশা ও ইজিবাইকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে দুইভাগে বিভক্ত করে দেয়া, ট্রাফিক ব্যবস্থাকে পূর্বের অবস্থায় নেয়া, বনানী থেকে মাটিডালি পর্যন্ত রাস্তা প্রশ্বস্ত করা, শহরের ছোট ছোট রাস্তাগুলোকে প্রশ্বস্ত করা, ৫ই আগষ্টের পর শহরের বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে যাওয়া রোড ডিভাইডারগুলো সংস্কার করা ২ নং রেল ক্রসিং এলাকায় আন্ডারপাস তৈরি করা। এছাড়া জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাস মালিক পক্ষ, শ্রমিক ও চালক পক্ষের সুদৃষ্টি এবং রিকশা ও ইজিবাইক চালকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে শহরের জ্যাম নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে বগুড়া পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বগুড়ার উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, এটি যদিও ট্রাফিক বিভাগের কাজ তার পরেও আমাদের কাছে যে কোন ধরনের সহযোগিতা চাইলে তা দিতে আমরা সর্বক্ষন প্রস্তুত। প্রশাসক আরো বলেন চলমান সময়ের এই জ্যাম থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে, আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন, জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের ট্রাফিক বিভাগ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ, মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষের প্রচেষ্টা এবং রিক্সা ও ইজিবাইক চালকদের সহযোগিতা। এই কর্মকর্তা আরো বলেন আমরা ই”ছা করলেই রিক্সা চালকদের পেটে আঘাত করতে পারিনা তাই তাদের সাথেও বসে কথা বলা দরকার।
বগুড়া ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোঃ সালেক উদ্দীন বলেন, পথচারী ও সাধারণ মানুষের অভিযোগের ভিত্তিতে করতোয়া গেটলক গাড়ি প্রায় ৩ দিন যাবৎ শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল বন্ধ রেখেছিলাম কিন্তু পরে রাজনৈতিক নেতারা আমাকে ফোন দিয়ে নানা ধরনের হুমকি ধামকি দেয়া শুরু করে। একারনেই বিষয়টি আর কন্টিনিউ করিনি। তবে এটা থামাতে হলে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) সুমন রঞ্জন সরকার বলেন, বগুড়া শহরের জ্যাম নিয়ন্ত্রনে ইতিমধ্যে আমরা জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার সাথে কথা বলে কাজ শুরু করছি। শহরের ছোট ছোট রাস্তাগুলো মডিফাই করা এবং লিংকআপ করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্কুলসহ বড় গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রন করতে এডিএমর এর সাথে কথা বলেছি এবং এডিসি শিক্ষা এ বিষয়ে কাজ করছেন। এছাড়া অটোরিকশাগুলোকে নিয়ন্ত্রনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই কাজগুলো শেষ হলে আমরা জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো বলে আশা করছি।
জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন বগুড়া শহরের জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া লিংক রোডগুলো বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে পৌরসভাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলেছি। ঠনঠনিয়া বাসটার্মিনাল সরে নেয়ার জন্য জায়গা নির্ধারনের কাজ চলছে। কি পরিমান অটোভ্যন চলে তার সংখ্যা নির্ণয় করে দুইভাগে বিভক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। ফুটপাত দিয়ে অসংখ্যা দোকান বসে, এগুলো সরিয়ে দিলেও আবারো আসে এ বিষয়টি নিয়েও চিন্তা করা হচ্ছে। করতোয়া গেটলক গাড়িগুলোকেও ভিন্ন পথ দেখে দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা নির্দেশনা মানছেনা বিষয়টি আমাকে অবগত করা হয়নি। এছাড়া করতোয়া গেটলক গাড়িগুলোর জন্য ট্রাফিক বিভাগকে রাজনৈতিকভাবে হ্যারেজ করা হচ্ছে তা আমাকে জানানো হয়নি। বড় বড় স্কুল বাসগুলো বিশেষ করে ক্যানপাবলিকের বড় বাসগুলো ছোট করার জন্য কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই কাজগুলো করতে পারলে জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।