বেকারত্বের অভিশাপে বাড়ছে অপরাধ

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন
Advertisement

মোঃ অমিত হাসান

২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি, উৎপাদন খাতে স্থবিরতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট—সব মিলিয়ে অর্থনীতির এক ভয়াবহ দুর্দশা তৈরি হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শ্রমবাজারে। কর্মসংস্থানের অভাব দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের জন্য। যারা দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হওয়ার কথা, তারাই আজ হতাশা, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে।

বেকারত্ব ও অপরাধ প্রবণতার সম্পর্ক

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ। কিন্তু চাকরি ও আয়ের সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা কার্যকরভাবে উৎপাদনশীল শক্তিতে পরিণত হতে পারছে না। যখন শিক্ষিত তরুণ দীর্ঘদিন বেকার থেকে যায়, তখন হতাশা থেকে তারা সহজে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়, সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বা সাইবার অপরাধে অংশ নেয়।  কথায় আছে “ক্ষুধার নখে ভয়” অর্থাৎ যখন একজন মানুষ খুব ক্ষুধার্ত বা জীবনধারায় বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তার কাছে আইন ও নৈতিকতার মূল্য কম মনে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে আসে বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ ৬০ হাজার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, বেকার মূলত তারাই, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজ খুঁজেছেন, কিন্তু মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পাননি। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। এছাড়াও বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী পুরুষ ও নারী উভয় ক্ষেত্রেই বেকারত্ব বাড়ছে তবে পুরুষদের হার নারীদের তুলনায় কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে বিশালসংখ্যক নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণী আছেন। তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। এই শ্রেণির বেকারদের মূলত “ছদ্মবেকার” বলা হয় যাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি পৌঁছেছে, যারা কাজ করছে না, পড়াশোনা করছে না এবং প্রশিক্ষণও নিতেছে না। আর বেকারত্বের অভিশাপে এই বড় জনগোষ্ঠীর মানুষরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও অনলাইন প্রতারণার মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেকারত্ব একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সংঘটিত মাদকসংক্রান্ত অপরাধের ঘটনায় আটককৃতদের ৭২% ছিল ২০-৩৫ বছর বয়সী। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের অভাব তরুণ-তরুণীদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা

গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। মাইক্রোক্রেডিট মডেলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা এবং কিছু নতুন কর্মসংস্থান প্রকল্প চালুর ক্ষেত্রে সরকার আংশিক সফলতা দেখিয়েছে। বিশেষত প্রায় ১২ লক্ষ নারী উদ্যোক্তা ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা পান এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিং উৎসাহ দেওয়ার উদ্যোগ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়াও প্রায় ১০ হাজার তরুণকে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে অস্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়। বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণে নতুন সমঝোতা হয়, যার ফলে সীমিত হলেও কর্মসংস্থান তৈরি হয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ টিকে থাকে।

তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, এসব উদ্যোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বল্পমেয়াদি ছিল। দীর্ঘমেয়াদি শিল্পায়ন, কৃষি-ভিত্তিক কর্মসংস্থান বা দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পরিকল্পনা চোখে পড়েনি।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগ ঝুঁকির কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি। ফলে শিল্প খাতে নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি থেমে যায়। অন্যদিকে, দক্ষতা-ঘাটতির কারণে অনেক তরুণ নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। শহরাঞ্চলে শিক্ষিত বেকারদের চাপ আরও বেড়ে যায়, যা হতাশা ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

কর্মমুখী শিক্ষা ও নতুন খাতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে এখনো শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ডিগ্রিনির্ভর, কিন্তু কর্মবাজার চায় দক্ষতা ও কারিগরি যোগ্যতা। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি-শিল্প প্রক্রিয়াকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পর্যটন এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো সেক্টরে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। তরুণদের কর্মমুখী শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তা তৈরি করার মাধ্যমে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এবং শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ স্কিল শেখানো হয়।

এছাড়া বিদেশে শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক আয় বাড়াতে পারে। এজন্য ভাষা শিক্ষা, প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি।

প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

যুবসমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রেখে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে হলে সমন্বিত প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কর্মসংস্থান সংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, উদ্যোক্তা সহায়তার জন্য সহজলভ্য ঋণ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হতে পারে কার্যকর পদক্ষেপ। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা জোরদার করা যেন চুরি, প্রতারণা, চাঁদাবাজি এবং জাতীয় অপরাধে দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত বিচার হয়।

সামাজিক নিরাপত্তা জোরালো করার মাধ্যমে দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করে তাদের জীবিকার উন্নতি বজায় রাখতে ভূমিকা রাখা। এছাড়াও জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে সমাজে নৈতিকতা, সামাজিক দায়বোধ ও সংস্কারের গুরুত্ব বাড়ানো।

সর্বোপরি, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু সরকারের প্রচেষ্টা নয়, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ এবং তরুণদেরও একযোগে কাজ করতে হবে। পরিকল্পিত কর্মসংস্থান, শিক্ষার আধুনিকায়ন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে যুবসমাজ অপরাধের অন্ধকার পথ থেকে বেরিয়ে এসে জাতির উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারবে।

 

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন
Advertisement

দৈনিক আমাদের কণ্ঠ