দেশের রাজনীতিতে একটি অগণতান্ত্রিক ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার জগদ্দল পাথর হয়ে বসেছিল সদ্য ক্ষমতাচ্যুত্ব সরকার । তারা গণতন্ত্রের গলা এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে, এদেশের সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিারটিও হারিয়েছিল তাদের কাছে। বিরোধি রাজনৈতিক দল গুলোকেও করে রেখেছিল একেবারে কোনঠাসা। মোটকথা ভোট ও মতপ্রকাশের অধিকার হারিয়ে বিদায়ি সরকারের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যথারীতি ফুসে উঠেছিল দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। বিষয়টি দেশ-বিদেশের সকলের কাছেই ছিল ওপেন সিক্রেট। জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোন সংস্থার কোন রকম মধ্যস্থার বিষয়টিও পায়নি কোন গুরুত্ব। ফলে একরকম এক ঘেয়ামিপনায় পরিনত হয়েছিল দেশের শাসক গোষ্ঠি। কিন্তু কথায় বলেনা যে আল্লার মাইর আমলের বাইর। এবারের সরকার পতনের বিষয়টিও ঠিক তেমনটাই মনে হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের খাম-খেয়ালীপনা ও ১৫ বছরের দম্ভ মাত্র ৩৬ দিনেই ভেঙ্গে চুরমার হয়েগেছে। তাও আবার হয়েছে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। ছাত্রদের দীর্ঘ দিনের পুষেরাখা বৈষম্য বিরোধি কোটা সংস্কার আন্দোল ধীরে ধীরে রূপ নেয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে। যার শেষ পরিনতি দিতে হল শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের মধ্যদিয়েই। এ কেবল আমরাই না এইমূহুর্তে সারা পৃথিবীই জানে যে,বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। সেটা জনসমর্থনধন্য। এই অভ্যুত্থানেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। যেটা আমাদের দেশের বিরোধি রাজণীতিবিদরা বিগত ১৫-১৬বছরেও করে দেখাতে পারেনি। সেটা মাত্র ৩৬দিনে করে দেখিয়েছে আমাদের ছাত্র সমাজ। বৈষম্য বিরোধি কোটা সংস্কারের পর এখন তারা নেমেছেন গোটা রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে। সে জন্য তাদের মতামতের ভিত্তিতেই গঠিত হল দল নিরপেক্ষ এক অন্তর্বর্তী সরকার।
এ সরকারের কাছে দেশের সাধারণ জনগণ এমন একটি সংস্কার চায়, যাতে করে খুব সহজে আর কেউ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সব জায়গায় জোরালোভাবে উঠছে। কাজেই জনগণের ইচ্ছা, আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর নূন্যতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। সুতরাং কোন কোন জায়গায় সংস্কার দরকার? কী ধরনের সংস্কার করতে হবে ? সেব বিষয়ও এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে জন্য সবার আগেই দাবি ঊঠেছে সংবিধান সংস্কারের। সে হোক সংবিধানের সংশোধন কিংবা পরিবর্তন। এ দাবি কেবল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষের দাবিই নয়। সংবিধান সংস্কারসহ সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনার দাবি আজ নানা মহলের। এর পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও । রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে সংস্কার শুরু হওয়া উচিত আমাদের সংবিধান থেকেই।
আমরা জানি, অসংখ্য ক্ষতে ক্ষত-বিক্ষত আমাদের সংবিধান। যেখানে অজস্র চীর ধরেছে ঘুণে খাওয়া কাঠ-কাগজের মত। পূর্বের শাসকগণ নিজেদের গা বাঁচাতে যে যারমত সিজার আর অস্ত্রপাচারে ক্ষত বিক্ষত করেছে আমাদের সংবিধান। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঠিক হাল ধরতে এখন অনেকটাই অপরাগ সেই পুরনো সংবিধান। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে সংস্কার শুরু হওয়া উচিত আমাদের সংবিধান থেকেই। তাছাড়া আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধান লেখা হয়েছিল ভারতের সংবিধানকে আদর্শ ধরে। যা অনেকটাই পুরনো ণীতি ও মতাদর্শের বলেই মনেকরছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কাজেই আমাদের লিখতে হবে নতুন করে আর সাজাতে হবে যুগপোযোগি করে। সে ক্ষেত্রে আমাদের নতুন (সংশোধিত বা লিখিত) সংবিধান হতে হবে অত্যন্ত সহজ ও সরল এবং তা করা উচিত আমাদের নতুন প্রজন্মের মতামতকে প্রধান্য দিয়ে। যেহেতু দেশটাকে নতুন করে স্বাধীন করেছে তারাই। সুতরাং দেশ সংস্কারে তাদের মতামতকে রাখতে হবে অগ্রভাগে। এমনটাই মনে করেন অনেক রাজনৈতিক যোদ্ধা। এ নিয়ে অনেকেরই মত ঠিক এমনটাই যে, দেশের সংবিধান যেন নতুন ভাবে লেখা হয়। যারা দেশকে নতুনভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাদের যেন সম্মানিত করা হয়।এমন পরিস্থিতে এটি পুন:লিখন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কতটা নিশ্চিত করা যাবে,তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটাকে বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধন করে সবই তার আদলে করেছেন। এজন্য তাকে সংবিধান লঙ্ঘন করে কোনো কিছুই করতে হয়নি। সাংবিধানিক পদগুলোও দলীয়করণ করেছে। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শেখ হাসিনা একাই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন, এটিও সংবিধানের আওতার বাইরে ছিল না। সুতরাং একইসঙ্গে বিদ্যমান অবস্থায় যদি কোনো দল নির্বাচনে ৩০০ আসনও পায় তারাও এই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না বলে মত প্রকাশ করেছেন এই রাজনৈতিক যোদ্ধা।
তার ভাষ্য, গত তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক ধরনের এক দলীয় ব্যবস্থা তৈরা করা হয়েছে, যার সংশোধন কোনো কাজে আসবে না। এটি পুন:লিখন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘ক’ ধারায় এমন কিছু জিনিস আনা হয়েছে যেটি সংশোধন করার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, সংবিধান সবার জানার বিষয়, বোঝার বিষয়। কিন্তু এটাকে দুর্বোধ্য করে ফেলা হয়েছে। সংবিধান কাটছাঁট করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো করে তৈরি করা হয়েছে। সংবিধানের জুজুর ভয় দেখিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। এই সংবিধান দিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ বা শাসনব্যবস্থা চলতে পারে না। এজন্য নতুন প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সংস্কার নয়, সংবিধানের পুন:লিখন করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীর পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আয়োজিত গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের এক সংলাপ অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।
তবে এর আগে আমাদেরকে আরো একটি বিষয়ে ভাবতে হবে যে,অর্ন্তবর্তী সরকার যে সংস্কার করবে, নির্বাচিত সরকার সেটা মানবে, এমন নিশ্চয়তা কী আছে? সুতরাং সংস্কার শুরুর আগেই প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অন্ত:ত এই মর্মে প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার দিতে হবে, যে সমস্ত মৌলিক সংস্কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবে সেগুলো তারা মেনে চলবে। এমন সংশয়ও কাজ করছে জনমনে। কেননা এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভালোভাবেই চেনেন। এ দুই দলের নেতাদের বৈশিষ্ট্যাদিও আমাদের ষোলপাতা পড়া আছে। সেই বৈশিষ্ট্যের কোনো ধারাই আমাদের পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।এর মূল কারনটা হলো আমাদের এক ধরনের অভ্যস্ততা। ১৯৯১ সালের পর থেকে দ্বি-দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও প্রকোপ দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। এ দুই দলের রাজনীতিকরাও তা জানেন। তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন, জনগণের পছন্দের তালিকায় থাকে হয় বিএনপি, না হয় আওয়ামী লীগ। এ কারণে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কেবল বিএনপিকেই আক্রমণ করেছে। বিএনপির ভাবনাও তা-ই। তারা মনে করেন, যেহেতেু এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, তাই আমরাই ক্ষমতাসীন, অন্তত অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যকলাপ তাই বলে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে আমরা বোধহয় অন্য ধরনের শিক্ষাও পেয়েছি। একটি দীর্ঘমেয়াদি দুঃশাসনের অবসান যে প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলের বাইরে আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে করা যায়, তা তারা প্রমাণ করেছেন। কাজেই সংবিধান সংশোধন বা পুনঃলিখনের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে অনতর্বর্তী সরকারকেই। তবে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে জনগণকে । আর এ কাজটি ছাত্র-জনতার নেতৃতেই¡ বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা, ছাত্রদের ত্যাগ ও আন্দোলনের মাধ্যমে বিদ্যমান সরকার গঠিত হয়েছে। এমনটি হলেই এখানে যে স্বৈরতান্ত্রিক ও বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলে আসছে, তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। সম্ভব হবে মানুষের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা। ঠিক এমনটাই মনে করেন রানৈতিক বিশ্লেষকরা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট মো.ইউসুফ আলী