প্রকৌশলী শেখ মোস্তাক আহম্মদ
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যা জনগণের নিকটতম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মূল স্তরগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) হলো সর্বনিম্ন প্রশাসনিক একক, যা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখে। তবে, ইউপি পর্যায়ে সম্পদের অপচয়, স্বচ্ছতার অভাব এবং জবাবদিহিতার সংকট থাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না। এই নিবন্ধে ইউনিয়ন পরিষদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও নিয়মকানুনের সংস্কারের মাধ্যমে সম্ভাবা সমাধান প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থ্য এবং সম্ভাব্য উন্নতির মধ্যে তুলনামূলক পরিসংখ্যান দ্বারা সংশ্লিষ্ট বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও ইউনিয়ন পরিষদ
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তিনটি স্তরে বিভক্ত:
১. জেলা পরিষদ (জেলার প্রশাসনিক কাঠামো।
২. উপজেলা পরিষদ (উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন)
৩. ইউনিয়ন পরিষদ (গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রশাসন)
এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ হলো সর্বনিম্ন প্রশাসনিক একক এবং এটি সরাসরি জনগণের সাথে সংযুক্ত থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার স্থানীয় সরকারের মূল ভিত্তি। এটি অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের দায়িত্বে রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় স¤প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, নিশ্চিত করে যে নীতি ও কর্মসূচিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে।
*স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন
*শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি উন্নয়নে সহায়তা প্রদান
*স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা
*দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সহায়তা বিতরণ
তবে, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকারিতা প্রায়শই সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতার অভাব এবং দুর্বল জবাবদিহিতার মতো ব্যবস্থাগত সমস্যাগুলোর কারণে বাধাগ্রস্তহয়।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ
১. বাজেট ও অর্থায়নের দুর্বলতা:
বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের জন্য অর্থায়নের প্রধান উৎসগুলো হলো:
*সরকারি অনুদান,
*স্থানীয় কর,
*উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল। তবে অনেক ইউনিয়ন পরিষদ পর্যাপ্ত বাজেট পায় না, ফলে তারা প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। ২০২৩ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৫% ইউনিয়ন পরিষদ অর্থসংকটে ভুগছে, যার ফলে তাদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের মাত্র ৪০% কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়, বাকি অংশ হয় অপব্যবহৃত বা বিলম্বিত হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৩০% ইউপি প্রকল্প দুর্বল পরিকল্পনা এবং দুর্নীতির কারণে অসম্পূর্ণ থাকে।
২. দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব:
দুর্নীতি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অন্যতম বড় সমস্যা। কিছু সাধারণ অনিয়ম হলো। উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল অপব্যবহার,দরপত্র দুর্নীতি,সরকারি অনুদানের অনিয়মিত বণ্টন । বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার খাতে ২৫-৩০% বাজেট অনিয়মের কারণে ব্যয় অকার্যকর হয়ে যায়। এই অনিয়ম দুর করার জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০২১ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে যে গ্রামীণ এলাকার ৬৫% নাগরিক জানেন না যে ইউনিয়ন পরিষদের তহবিল কীভাবে ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ২০% ইউপি তাদের কার্যক্রমের সর্বজনীনভাবে প্রবেশযোগা রেকর্ড রাখে।
৩. জবাবদিহিতার অভাব :
যেহেতু ইউনিয়ন পরিষদ সরাসরি স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধি, তাই তাদের প্রতি জনগণের জবাবদিহিতা থাকা দরকার। তবে, বাস্তবতায় দেখা যায় যে,
*নাগরিকদের মতামত গ্রহণের সুযোগ কম,
*প্রকল্প ও বাজেট সংক্রান্ত তথ্য সহজলভ্য নয়,
*স্থানীয় জনগণের তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল।
ব্র্যাকের ইওএউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৬০% জনগণ মনে করেন স্থানীয় পরিষদের কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত।
*একই টিআইবি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ৭০% ইউপি কার্যকর অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার অভাবে রয়েছে, যার ফলে নাগরিকদের অভিযোগ জানানোর কোন উপায় নেই।
*দুর্নীতি এখনও ব্যাপক, ২০২৩ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন (এসিসি) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫% ইউপি সদস্য তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।
৪.প্রযুক্তিগত সংহতির অভাব।
*বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর ২০২২ সালের গবেষণায় দেখা গেছে যে মাত্র ১৫% ইউপি রেকর্ড রাখা এবং যোগাযোগের জন্য ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করে।
*ম্যানুয়াল সিস্টেমের কারণে ত্রæটি দেখা যায়, ২০২৩ সালের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এর নিরীক্ষা অনুযায়ী ৪০% আর্থিক রেকর্ড ত্রæটিপূর্ণ।
প্রযুক্তি ও নীতিমালার মাধ্যমে সমাধান:
প্রযুক্তি এবং নীতিমালার মাধ্যমে নিম্নলিখিত উপায়ে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব:
১.ডিজিটাল রূপান্তর।
*ই-গভর্নেন্স প¬্যাটফর্ম ডিজিটাল প¬্যাটফর্ম চালু করলে তহবিল বাবহারের দক্ষতা ৮০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ভারত ও নেপালের পাইলট প্রকল্পে দেখা গেছে।
*মোবাইল অ্যাপি¬কেশন: নাগরিক অংশগ্রহণের জন্য মোবাইল অ্যাপ জনসচেতনতা বাড়াতে পারে ৭৫% পর্যন্ত, যা শ্রীলঙ্কার অনুরূপ উদ্যোগে দেখা গেছে।
২. ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ব-এচ) স¤প্রসারণ
ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ব-এচ) ব্যবস্থা স¤প্রসারিত করা হলে দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং আর্থিক অপচয় কমবে। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ই-জিপি ব্যবস্থার কারণে জিডিপিতে বছরে ১.৪ থেকে ১.৬ বিলিয়ন অতিরিক্ত অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে।
৩. জবাবদিহিতা শক্তিশালীকরণ।
*স্বাধীন অডিট কমিটি গঠন করলে সম্মতি হার ৯০% পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার সফল মডেলে দেখা গেছে।
*বাধ্যতামূলক পাবলিক হিয়ারিং ইউপি কর্মক্ষমতার প্রতি নাগরিক সন্তুষ্টি ৮৫% পর্যন্ত বাড়াতে পারে, বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী।
*ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় ওয়ার্ড সভা সক্রিয়, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যকারিতা ৩০% বেশি।
৪. ব¬কচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার
বøকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিলের লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা সম্ভব, যা অনিয়ম রোধ করতে সহায়ক হবে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ব¬কচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বø¬কচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে দুর্নীতি ৩০% কমতে পারে, যা জর্জিয়া ও এস্তোনিয়ার পাইলট প্রকল্পে প্রমাণিত।
৫. সক্ষমতা বৃদ্ধি
*ইউপি সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রকল্প সম্পূর্ণতার হার ৭০% পর্যন্ত উন্নত করতে পারে যা ফিলিপাইনের ক্ষমতা বৃদ্ধি উদ্যোগে দেখা গেছে।
*যুবকদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করলে প্রযুক্তি সচেতন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ৫০% পর্যন্ত বাড়তে পারে, ইন্দোনেশিয়ার তথ্য অনুযায়ী।
৬. নিয়মকানুনের সংস্কার
*ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং সর্বজনীন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করলে স্বচ্ছতার মাত্রা ৯০% পর্যন্ত উন্নত হতে পারে, যা রুয়ান্ডার ই গভর্নেন্স সংস্কারে দেখা গেছে।
দুর্নীতির জন্য কঠোর শান্তি তহবিলের অপব্যবহার ৪০% কমাতে পারে, ২০২৩ সালের জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী।
পরিসংখ্যানগত তুলনা: বর্তমান অবস্থা বনাম সম্ভাব্য উন্নতি
সূচক-বর্তমান অবস্থা-সম্ভাব্য উন্নতি
তহবিল ব্যবহারের দক্ষতা ৪০% সম্ভাব্য উন্নতি ৮০%,ইউপি কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা ৩৫%, সম্ভাব্য উন্নতি৭৫%,দুর্নীতি হ্রাস,২৫% সম্ভাব্য উন্নতি ৩০% হ্রাস,ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার ১৫% সম্ভাব্য উন্নতি ৯০%,
প্রকল্প সম্পূর্ণতার হার ৭০%অসম্পূর্ণ সম্ভাব্য উন্নতি ৭০%সম্পূর্ণ,৭০%
নাগরিক সন্তুষ্টি ৫০% সম্ভাব্য উন্নতি ৮৫% ।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন প্রবর্তিত হয়ে তার প্রশাষনিক কিছু বিষয় সংশোধিত হলেও তার মধ্যে উপরোল্লখিত বিষয়াবলী সংযোজন করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। ইউনিয়ন পরিষদ বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, তবে এর সম্ভাবনা ব্যবস্থাগত চ্যালেঞ্জের কারণে সীমিত। আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ এবং নিয়মকানুনের সংস্কারের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে সমাধান করা সম্ভব। ডিজিটাল রূপান্তর, বøকচেইন সংহতকরণ এবং শক্তিশালী জবাবদিহিতা ব্যবস্থা স্থানীয় শাসনে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যা স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে, ইউনিয়ন
পরিষদ সত্যিকার অর্থে স্থানীয় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে। নীতিমালা সংস্কার এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করে তোলা সম্ভব।
- দৈনিক আমাদের কণ্ঠ: প্রকাশিত সংবাদ, বিশেষ সংবাদ, শীর্ষ সংবাদ, সংবাদ শিরোনাম