কলাপাড়ায় বাণিজ্যিকভাবে গোল গাছের আবাদ করছেন কৃষকরা  

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন
Advertisement

এস এম আলমগীর হোসেন, কলাপাড়াঃ

গোল গাছ। একটি অর্থকড়ি ফসল। উপকূলীয় সাগরপারের এ জনপদে গোল গাছ সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পরিচিত। বহুমুখি ব্যবহারে এর বিকল্প নেই। এক সময়, (ষাটরে দশক) এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে গোল গাছ ছিল না। বিশেষ করে জোয়ারের পানি প্রবহমান এমন খালের পাড়ে কিংবা বিলে গোলগাছের বাগান ছিল। খাল-বিলের এই অঞ্চলে মাইলের পর মাইল গোল বাগানে পরিপূর্ণ ছিল। গোল গাছের কদর ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে গোলের গুড়ের রয়েছে আলাদা কদর। কৃষিকাজের পাশাপাশি গোলাগাছের আবাদ করা যায়। আশির দশক পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ ঘরের চালের ছাউনি, বেড়া দিত গোলপাতা দিয়ে। আর গোলের পাতা কাটার পরে গোড়ার অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিছুই ফেলনা নয়। এখন গোল গাছ আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে।

‘৬০ এর দশকে কৃষিজমি চাষাবাদের উপযোগী করতে লোনা পানির প্লাবন ঠেকাতে নদীর পাড় ঘিরে বেড়িবাঁধ করা শুরু হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এবং ধানসহ রবিশস্য ও সবজির আবাদ করতে এই বাঁধ দেয়া হয়। নির্মিত হয় বাঁধের ভিতরের খালের সঙ্গে পানি নিয়ন্ত্রণে স্লুইস গেট। জোয়ার-ভাটার লোনা পানিতে বেচে থাকার এই গাছ তখন থেকে কমতে থাকে। এখনও সব ক’টি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে গোল গাছ রয়েছে। বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরে কিছু কিছু গোল গাছের বাগান দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গোল গাছ রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নে। বিশেষ করে নবীপুর এবং সোনাতলা গ্রামের চাষীরা এখনও গোল গাছের বাগান সংরক্ষণ করে আসছেন। সস্বাদু হওয়ায় গোলের গুড় সংগ্রহ করছেন, বিক্রি করছেন। বাণিজ্যিকভাবে নতুন নতুন বাগানও করছেন কেউ। লাভের মুখ দেখছেন প্রায় এক শ’ কৃষক পরিবার। এখন গোলের গুড়ের চাহিদা এই অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা তাঁদের প্রিয়জনের জন্য গোলের গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

গোলগাছ ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপক‚লীয় এবং মোহনা এলাকার এক প্রকার পাম জাতীয় উদ্ভিদ। যা নিপা পাম নামে পরিচিত। এটি পামের একমাত্র প্রজাতি, যা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটা মূল গণনিপা হতে উদ্ভ‚ত একমাত্র প্রজাতি যার উপপ্রজাতি নিপোডিয়া। এই অঞ্চল ছাড়াও বাগেরহাটের মোংলার মিঠাখালীতে খোনকার বেড় গ্রামে এক কৃষকের প্রায় দুই বিঘা জমিতে গোলগাছের বাগান রয়েছে। যেখানে কৃষি অফিস পরামর্শ দিয়ে ২০১০ সালের দিকে রস থেকে গুড় তৈরিতে সহায়তা করছিল। মোংলার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পরিবেশবাদি সংগঠক মোঃ নুর এ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে বর্তমানে সেখানকার গোলের গুড় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে গোল গাছ রয়েছে। তবে নীলগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে গুড় সংগ্রহের জন্য কয়েকটি গোলগাছের বাগান রয়েছে। বিশেষ করে নবীপুরের চাষীরা গোলবাগানের বিশেষ পরিচর্যা করেন।

গোল গাছ দেখতে গোল নয়। এর পাতা নারিকেল গাছের মতো লম্বা হয়। ১০ ফুট থেকে কোন কোন উর্বর জায়গায় ১৫-১৬ ফুট দীর্ঘ গোলগাছ দেখা যায়। বিশেষ করে শীত মৌসুমের আগেই গোল গাছে ফল ধরে। একটি কান্ডে ফল ধরে। যাকে স্থানীয় ভাষায় গাবনা বলা হয়। তাল গাছের ডগার মতো গোলের কান্ডে এই গাবনা বা ফল ধরে। এমন ফলওয়ালা কান্ড কেটে রস সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় ছড়াসহ গাবনাটি কোন এক পূর্ণিমায় পায়ের লাথিতে কান্ডসহ নিচের দিকে বাকা করা হয়। কেউ কেউ কাদা মেখে রাখেন। গোল চাষীদের ধারনা বা বিশ্বাস নির্দিষ্ট গোনে গাবনাসহ কান্ডটি নিচের দিকে বাকা করলে বেশি রস পাওয়া যায়। এরপরে ফলটি থোকাসহ এক কোপে কেটে কান্ডটি তালের রস সংগ্রহের মতো অল্প অল্প কেটে গোলের রস সংগ্রহ করতে থাকে। গুনগত কারণে গোলের এবং খেজুরের গুড় সহজভাবে আলাদা করা যায়। এরপরে খেজুর গুড়ের মতো আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কিছুটা নোন্তা-মিঠার মিশ্রণ এই গুড়। ডায়াবেটিসের রোগীতে খেতে পারে বলে গুড় সংগ্রহকারীদের মতামত। আবার খেজুরের রসের মতো এই রস খেতেও সুস্বাদু। স্বাদের পাশাপাশি গোলের গুড়ের ওষধিগুণ রয়েছে।

কথিত রয়েছে, গোলের গুড় কিংবা রস খেলে পেটের কৃমি বিনাশ হয়। আবার বাসি রস খেলে তাড়ির মতো নেশা হয়। কলাপাড়া উপজেলার প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার জানান, এই গুড়ের এক ধরনের ভিন্নতর স্বাদ রয়েছে। আর যেহেতু এই গুড়ে খনিজ লবণ রয়েছে। যেটি মানুষের জন্য অনেক ক্ষেত্রে উপকারী।

নীলগঞ্জের নবীপুর গ্রামের চাষীরা জানান, নিচু জলাভ‚মি, খালের পাড়ে কিংবা মরা খালে যেখানে লোনা পানির প্রবাহ থাকে, জোয়ার-ভাটা প্রবাহমান সেখানে সহজেই প্রাকৃতিকভাবে গোলগাছ বেড়ে ওঠে। গোল গাছের বাগানকে স্থানীয়ভাবে গোলবাওর বলা হয়। প্রবীণ চাষী হরি নারায়ন মিত্র (৮০) জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে তার দাদা বৈকুন্ঠ মিত্র গোল গাছের গুড় সংগ্রহ করতেন। যা তারা আজও ধরে রেখেছেন। অন্তত দুই একর জমিতে এখনও তার বাগান রয়েছে। প্রায় চার শ’ গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের মতো রয়েছে প্রায় দুই শ’ গাছ। প্রতিদিন দুই বারে চার কলসী রস সংগ্রহ করেন। গড়ে ৫-৬ কেজি গুড় তৈরি করতে পারেন। অগ্রহায়ন থেকে প্রায় চৈত্র মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ করতে পারেন। গোল গাছে বৈশাখে গাবনা বা ফল ধরলে অগ্রহায়ণ মাসে কান্ডটি পায়ের চাপে রস নিচে ভার করতে নুইয়ে দেয়। কেউ কেউ কাদায় লেপটে রাখেন। দুই সপ্তাহ পরে গাবনার ছড়ার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে কান্ডের মাথা থেকে ধারালো দাও দিয়ে এক কোপে গাবনা কেটে ফেলা হয়।

প্রচলিত বিশ্বাস, পূর্ণিমায় ডাঁটি (কান্ড) থেকে ফল কাটলে রস বেশি হয়। কাটা অংশ তিন/চারদিন শুকানো হয়। এরপরে তিনদিন সকাল-বিকেল দুইবার কান্ডের আগা কাটা অংশ পাতলা করে চেঁছে ফেলা হয়। তারপরে কান্ডের আগা পাতলা করে দিনে এক বার কেটে ছোট্ট হাড়ি কিংবা প্লাস্টিকের পাত্র ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মানসম্পন্ন গুড় তৈরির জন্য অধিকাংশ চাষী প্রতিদিন রস সংগ্রহের পাত্র ধৌত করেন। রোদে শুকানোর পরে ফের রস সংগ্রহ করেন। একটি কান্ড (ডাটি) থেকে ফি দিন ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। এই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।

জানান হরি নারায়ন, ১৯৭৪ সালে এই গুড় ৫-৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন ভালো গুড়ের দাম কেজি ২৫০থেকে ৩০০ টাকা। প্রায় ২৫ লিটার রস ভর্তি এক কলসি রস থেকে চার-পাঁচ কেজি গুড় পাওয়া যায়। গোলগাছ চাষ খুবই লাভজনক এবং সহজও। গোলগাছের গাবনা বা বীজ লোনা পানিতে পুতে দিলেই চারা গঁজায়। বেড়ে ওঠে। খরচ কম। চাষে রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশকের ব্যবহার লাগে না। তবে কৃষকের অভিযোগ, ভরাট খালগুলোকে কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় ওই সব জায়গায় বন্দোবস্তগ্রহীতারা পুকুর-বাড়িঘর করে গোলবাগান কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। নবীপুর গ্রমের উত্তম কুমার সরকার জানান, এখন বাড়িতে বসেই তিনি গুড় বিক্রির অর্ডার পেয়ে আসছেন। চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। তার তথ্যমতে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে ২২জন, নেয়ামতপুর গ্রামে আট জন, গুটটাবাছা গ্রামে এক জন, চাঁদপাড়া গ্রামে ৭/৮ জন, তাহেরপুর গ্রামে ৫/৬ জন, দৌলতপুর গ্রামে তিন জন, নাওভাঙ্গায় চার জন, ইসলামপুর গ্রামে চার জন। এছাড়া মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের চরপাড়া-তেগাছিয়ায় তিন/চারজন। চাকামইয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া ও নেওয়াপাড়া গ্রামে ৬/৭ পরিবার গোলের গুড় তৈরি করেন। করেন গোল গাছের আবাদ। এ চাষীর হিসেবে প্রায় ৮০ জন চাষী বানিজ্যিকভাবে গোলের চাষাবাদ করেন। গুড় বিক্রি করেন।

এসব চাষীরা জানান, একেকটি পরিবার ফি মৌসুমে ৩০-৫০ হাজার টাকা লাভ করেন গোলের গুড় বিক্রি করে। মঙ্গলবার কলাপাড়ার সাপ্তাহিক হাঁটের দিনে ৩০-৪০ মণ গোলের গুড় বিক্রি হয়। এসব চাষীদের তথ্যমতে ফি বছর অন্তত ৪৫-৫০ লাখ টাকার গোলের গুড় কলাপাড়ায় উৎপাদন হয়। বর্তমানে গোল গাছ অর্থকরি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কৃষকের কাছে।

সচেতন চাষী উত্তম সরকার জানালেন, ১০ কড়া অর্থাৎ ৩০ শতক জমিতে ১০ মণ ধান পাওয়া যায়না। আর সেখানে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকার গোলের গুড় পাওয়া যায়। এখানে বর্তমানে পাঁচ শ’ থেকে ছয় শ’ মণ গোলের গুড়ের উৎপাদন হয় বলে চাষীদের প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে। বর্তমানে চাষীরা নিজের চাষের জমির সীমানায় খালের পাড়ে, বিলের মধ্যেও গোলবাগান পরিচর্যা করে যাচ্ছেন। যা থেকে গোলের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করছেন।

চাষীরা জানালেন, গাছের বীজ জোয়ার-ভাটার লোনা পানির প্রবাহ রয়েছে এমন কাদামাটিতে রোপন করলে গাছ জন্মায়। পাঁচ-ছয় বছরে ফল ধরে। তবে বেড়িবাঁধের বাইরে নদীতীরের চরভ‚মিতে ব্যাপকভাবে গোলের আবাদ করলে গুড় ছাড়াও গোলের পাতা ছাউনি বেড়া, জ্বালানিসহ বহুমুখি ব্যবহার করতে পারবে এই জনপদের মানুষ। নীলগঞ্জের গোলবাগানকে ঘিরে মুক্তযুদ্ধকালীন গল্পও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ কলাপাড়া পৌর শহরের শত শত পরিবার মুক্তযুদ্ধকালীন সময় জীবন বাচাতে বাড়িঘর ছেড়ে গহীন গোলবাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গণমাধ্যম কর্মী অমল মুখার্জী এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা সপরিবারে ওই এলাকায় মুক্তযুদ্ধকালে রাজাকারদের ভয়ে জীবন বাচাতে পালিয়ে ছিলেন। এক সময় গোল বাগানের মাঝের খালে কুমির থাকত বলেও জানালেন হরি নারায়ন মিত্র।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন জানান, গোল চাষীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া গোলের চাষ আরও কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এমন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বনবিভাগ কলাপাড়া সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে আন্ধারমানিকসহ বিভিন্ন নদী তীরের চরভ‚মিতে তারা প্রায় ৬০ হাজার গোল গাছের চারা রোপন করা হয়েছে। আরও ব্যাপকভাবে গোলবাগান করার পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।

 

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Advertisement

Contact with your
Creative & Technology Partner

Advertisement