বিশেষ প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখানে কর্মরত হাজারো শ্রমিকের জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত হয়ে উঠছে দুঃসহ, অনিরাপদ ও শোষণমূলক। একটি সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেট, অকার্যকর ইউনিয়ন ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় এই শ্রমিকরা আজ ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত।
‘সুদি বাবুল সিন্ডিকেট’: আধা মজুরিতে শ্রম, পূর্ণ লাভে মধ্যস্থতাকারী বন্দরের ক্রেন অপারেটরদের একসময় একটি মাত্র সংগঠন থাকলেও বর্তমানে দুটি বিভক্ত সংগঠন গড়ে উঠেছে।যার কার্যকারিতা তেমন নেই বললেই চলে,কেননা এ সংগঠন দুটির কার্যকারিতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শ্রমিক শোষণ সিন্ডিকেটের একটির নেতৃত্বে রয়েছেন সুদি বাবুল নামক এক ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্টিভেডর কোম্পানিগুলোর কিছু মালিককে সুবিধা দিয়ে নিজের মাধ্যমে শ্রমিক সরবরাহের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন। শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে তার মাধ্যমে প্রায় অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে।সাধারন ক্রেন অপারেটর গন তাই তাদের বৈধ সংগঠনের বাহিরে এসে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই কাজের জন্য ধন্না দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও রয়েছে ‘জাফর-মুন্সি’ সিন্ডিকেট: মালিকের সাথে আতাত, শ্রমিকের উপর শোষণ নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ ও মজুরি প্রদান করার দায়িত্ব স্টিভেডর কোম্পানির হলেও, বাস্তবে কিছু কোম্পানি মাসের পর মাস বিল আটকে রাখে। এই সুযোগে জাফর ও মুন্সি নামের দুই ব্যক্তি শ্রমিকদের বিল স্বল্প মূল্যে কিনে নেয় এবং পরে পুরো বিল তুলে নেয়, যার পেছনে রয়েছেন হাসেম এন্ড সন্স স্টিভেডর কোম্পানির মালিক জুলফিকার আলী।
জুলফিকার আলী একজন বিতর্কিত ব্যক্তি, যিনি বর্তমানে বিএনপির মোংলা পৌর আহ্বায়ক এবং স্টিভেডর এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হলেও অতীতে ছিলেন আওয়ামী লীগ ঘরানার ঘনিষ্ঠ। তৎকালীন খুলনা সিটি মেয়র ও বাগেরহাট-৩ আসনের এমপি বেগম হাবিবুন নাহারের ‘ধর্মপুত্র’ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন এবং ‘ধর্মমা’ ও ‘ধর্মবাবা’ বলে ডাকতেন তাঁদের। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর লাভবান হন। বর্তমানে তিনি মোংলা পৌর বিএনপির সভাপতির পদ দখল করতে মরিয়া, এবং যে কোনো মূল্যে—বিশাল অর্থ ব্যয়ে হলেও—উক্ত পদে বসার পরিকল্পনা করছেন।
তাঁর প্রভাবে তারই দোসর জাফর-মুন্সির মাধ্যমে শ্রমিকদের বিল আটকে রেখে তা কম দামে কিনে নিয়ে একপ্রকার বাধ্যতামূলক সমর্থন আদায় করা হয়। শ্রমিকদের কথা বলার সুযোগ নেই, ভয় আর চাকরি হারানোর আতঙ্কে তারা মুখ বুজে সহ্য করছে।
মোংলা বন্দর শ্রমিক কর্মচারী সংঘ: শ্রমিকের নয়, মালিকের পক্ষে কাজ করছে। মোংলা বন্দরে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় রয়েছে ‘মোংলা বন্দর শ্রমিক কর্মচারী সংঘ’ নামের একটি ইউনিয়ন, তবে নামমাত্র। সেখানে এডহক কমিটির নামে নামমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্তরা অধিকাংশই মালিক পক্ষের আত্মীয় বা প্রভাবিত ব্যক্তি। শ্রমিকদের কোনো সমস্যা বা অভিযোগ সমাধানের নিমিত্তে নেই কোন কার্যক্রম, বরং শ্রমিকদের দমিয়ে রাখতেই তারা সতর্ক ও সক্রিয়।
অস্থায়ী নিয়োগ আর একক সিদ্ধান্তে চাকরিচ্যুতি: শ্রমিকের নেই কোনো নিরাপত্তা বন্দরের নিয়োগকৃত সকল স্টিভেডর কোম্পানি শ্রমিকদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করে। তারা দিনের পর দিন রোদে-বৃষ্টিতে কাজ করলেও স্থায়ী পদ পান না। কোনো শ্রমিক যদি কোম্পানির মনোমত না হয়, তাহলে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। নির্যাতন, গালাগালি আর ভয়ভীতি: নীরবে সহ্য করা ছাড়া বিকল্প নেই সাধারণ শ্রমিকদের। মালিক পক্ষের অনেকেই শ্রমিকদের ছোটখাটো ভুলে গালাগালি, এমনকি শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করে থাকেন। চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না।
চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত শ্রমিকরা: হাসপাতাল আছে, সেবা নেই মোংলা বন্দরের শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিগত ফ্যেসিস্ট আওয়ামী আমলে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করা হয়েছিল—যার উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই হাসপাতাল কেবল উদ্বোধনের ফিতা কাটা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আজও কোনো শ্রমিক সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন—এমন নজির নেই। একপ্রকার লোক দেখানো প্রকল্প হিসেবে সেটি পড়ে আছে অকার্যকর অবস্থায়। শ্রমিকরা আহত হলে বা অসুস্থ হলে তাদের ব্যক্তিগত খরচেই চিকিৎসা নিতে হয়, যা তাদের সীমিত আয়ের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
অনেক শ্রমিক জানিয়েছেন, গুরুতর দুর্ঘটনার পরও তারা হাসপাতালের দ্বারে গিয়ে ফিরে এসেছেন খালি হাতে। চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, ওষুধের অভাব ও প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতার কারণে শ্রমিকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল আজ শ্রমিকহীন, সেবাহীন এক পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে।
পরিবর্তন প্রয়োজন এখনই
মোংলা বন্দরের শ্রমিকরা যেন বন্দী এক কু-চক্রের হাতে। সিন্ডিকেটের মধ্যস্থতায় অর্ধেক মজুরি, ইউনিয়নের নিষ্ক্রিয়তা, অস্থায়ী নিয়োগের অমানবিকতা ও নিপীড়নের ভয়—সব মিলিয়ে শ্রমিকরা বেঁচে আছেন শুধু নিজের রক্ত আর ঘামে। অথচ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তারাই প্রধান অবদান রাখছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাধারণ শ্রমিকদের দাবি, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, শ্রম মন্ত্রণালয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মানবাধিকার সংস্থাসমূহ যেন দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শ্রমিকদের স্থায়ী নিয়োগ, সঠিক সময়ের মধ্যে ন্যায্য মজুরি প্রদান ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাই হোক সংস্কারের প্রধান শর্ত।