রংপুরে মুজিব বর্ষের আশ্রয়ন প্রকল্পের নামে ইউএনও ও আ.লীগের যৌথ লুটপাট 

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন
Advertisement

হারুন-অর-রশিদ বাবু; রংপুর

রংপুরের পীরগাছায় ফসলি জমিতে মুজিব বর্ষের আশ্রয়ন প্রকল্পের ৩২০টি বাড়ি, ৫ আগষ্ট পরবর্তী তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন করার অভিযোগ উঠেছে। দরপত্র ছাড়াই আ. লীগ নেতার মাধ্যমে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা, কাবিখা প্রকল্পে অবৈধ ড্রেজার মেশিনের ব্যবহার এবং কোটি টাকার মাটি বিক্রিসহ ঘর বিতরণে আর্থিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে।

পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সময়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি প্রকল্প। যার মাধ্যমে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বাসস্থান নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার দলবল নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেলেও তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত পীরগাছার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অন্নদানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে নাগরিক সুবিধা ছাড়াই শল্লারবিলে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দ্বারা দায়সারাভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩২০ টি বাড়ি নির্মাণ করেন। যেখানে পুনর্বাসিতদের জন্য কমিউনিটি সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ/মন্দির ও কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মক্তব, খেলার মাঠ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা কিছুই নেই।

জানা যায়, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে জেতানো জন্য জাল ভোট প্রদানকারী, দিনের ভোট রাতে দেখানো ও ডামি নির্বাচনের মূল কারিগরদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বাসস্থানের জন্য মুজিব বর্ষের  আশ্রয়ন প্রকল্প হাতে নেন। অনেক ব্যয়বহুল প্রকল্প হলেও তৎকালিন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দরপত্র ছাড়াই উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৪৩০টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ আসে পীরগাছায়। প্রথম অবস্থায় ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। হাসিনা পালানোর পরে ২০২৪ সালের শেষের দিকে বাকি ৩২০টি ঘর নির্মাণ শুরু হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বরাদ্দের পরিমাণ অনুযায়ী ৫ থেকে ৬ ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের পরিবর্তে দেড় থেকে তিন ফুট উঁচু করা হয়েছে। যা বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা। ৩২০ টি ঘর নির্মাণকাজ শুরুর আগে সেখানে ৫-৬ ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৫৬৬ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রচুর মাটি ভরাটের মাধ্যমে জমি প্রস্তুত করা প্রয়োজন এমন জমি পরিহার করার আইন থাকলেও তা অমান্য করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে, মাটি ভরাটের নামে কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৬৬ টন গম বরাদ্দ নেন। কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণ শ্রমিক ব্যবহার করার আইন থাকলেও তা অমান্য করে, অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাশের ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে নামমাত্র মাটি ভরাট করে ৫৬৬ টন গমের প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়েছে।

এছাড়াও আশ্রয়ণ প্রকল্পকে ঝুঁকিতে ফেলে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রিও করেছেন। পীরগাছা উপজেলায় ওই আশ্রয়ন প্রকল্পের ৩২০ বাড়ি নির্মাণের পূর্বেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

কিন্তু প্রকল্পের সভাপতি ইউএনও একক সিদ্ধান্তে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজার রহমান সংগ্রামকে সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে শল্লারবিলে ৩১৫ ও অন্নদানগর কলেজ সংলগ্ন পাঁচটি বাড়ি/ঘর নির্মাণ করেন। শল্লারবিলের আশ্রয়ন প্রকল্পে সর্বমোট ৪২৫ টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নেই কোন নাগরিক সুবিধা। এরই মধ্যে তাসনিম ও কহিনুর বেগমসহ ৪জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদেরকে প্রকল্প সীমানার বাইরে দাফন করা হয়েছে। অনেকের কবুলিয়ত সম্পাদন হয়নি, ভিজিএফ প্রদান করার কথা থাকলেও গত ঈদুল ফিতরে তা দেয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা একক বাড়ি নেই। ৫/৭ পরিবার মিলে একটি টিউবওয়েল ব্যবহার করতে হচ্ছে  অপরদিকে বিদ্যুৎ পায়নি অনেকেই।এছাড়াও প্রকল্পটিতে করা হয়েছে বহুমুখী অনিয়ম।

স্থানীয় বাসিন্দা খন্দকার মাহবুবার রহমান টিটুল অভিযোগ করে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘেঁষেই ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপের সাহায্যে বালু উত্তোলন করে সামান্য ব্যবহার করে সমস্ত বিক্রি করা হয়েছে।

তবে ইউএনও মো. নাজমুল হক সুমন মনে করেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করায় কোনো অনিয়ম হয়নি। সরকারি কাজে ড্রেজার ব্যবহারে কোনো বাধা নেই।

উর্বর কৃষি জমি, নদী ভাঙ্গন প্রবণ এলাকা, পুকুর ও জলাশয়ের কিনারে অবস্থিত জমি বাদ দিয়ে মুজিব বর্ষের আশ্রয়ন করার কথা থাকলেও অন্নদানগর ইউনিয়নের শল্লার বিলে ফসলি জমিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। স্থানীয় চাষি আব্দুস সালাম বলেন, অত্র এলাকার মধ্যে এই বিলে ধানের বাম্পার ফলন হতো। সরকার কি বুঝে বিলের মাঝে আশ্রয়ন প্রকল্প করলো আমাদের বুঝে আসেনা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন আইনে; আশ্রয়ন প্রকল্পের জমি নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (PIC)’র উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বলা হয়েছে, নিজ গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচন সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতেন, সে গুলো বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয়নের স্থান নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু পীরগাছা উপজেলার একাধিক আশ্রয়ন পরিদর্শন করে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোন চিত্র দেখা যায়নি।

উপজেলার পারুল ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড নাগদাহ আশ্রয়ন ঘুরে দেখা, গেছে ২ বছর না যেতেই জরাজীর্ণ হয়েছে মুজিব বর্ষের ঘর। বাসিন্দারা আমার দেশকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে  আশ্রয়নে হাটু পানি জমে থাকে। আমরা হাটাচলা করতে পারিনা। ঘর নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় আমাদের দুর্ভোগের শেষ নাই। দালানে ফাটল ধরেছে, প্রত্যেকটি ঘরে বৃষ্টির পানি পরে। দুই বছরেই চালে ব্যবহৃত টিনে ধরেছে জং! কাঠ পঁচে গেছে।

আশ্রয়নের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম বলেন, আমরা পারুল ইউপি চেয়ারম্যানকে এক লাখ টাকা দিয়ে ঘর নিয়েছি। শিখা আক্তার বলেন,পারুল ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে সুমনের হাতে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর পেয়েছি। সামান্য বৃষ্টি হলে আমাদের এখানে পানি জমে থাকে খুব বাজে একটা পরিবেশে আছি। মেম্বার চেয়ারম্যান ইউএনও কেউ আমাদের খবর নেয়না।

স্থানীয় বাসিন্দা আয়শা বেগম বলেন, এই আশ্রয়ন প্রকল্পের যায়গা ব্যক্তি মালিকানা। এই যায়গা নিয়ে মামলা চলছে সে জন্য এখানকার কোন উন্নয়ন নাই। মালিকানা যায়গা পীরগাছা উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান, ও আওয়ামী লীগের লোকজন মিলে জোরপূর্বক দখল করছে। এখানে আশ্রিত সবাই চেয়ারম্যান, মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের টাকা দিয়ে ঘর নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ৩নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ও ২নং ইউপি সদস্য সাদিকুল ইসলাম কাফি আশ্রিতদের নিকট মোটা অংকের টাকা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের নব্দীগঞ্জ বাজার সংলগ্ন আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যক্তি মালিকানা ২৩ শতাংশ জমি দখলে অভিযোগ করেন জমির মালিক আব্দুর রহিম। তিনি বলেন , বিগত আওয়ামী শাসনামলে দেশে কোন আইন, বিচার ছিলনা। আমাদের জমি পীরগাছা উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান নুর আলমের নেতৃত্বে দখল করা হয়েছে! ভূমি মন্ত্রণালয়,জেলা প্রশাসক রংপুর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পীরগাছা, এসিল্যান্ড পীরগাছায় বারংবার লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি। বিচার চাইতে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে গেলে তারা সবাই একটা কথে বলেছে মুজিব বর্ষের প্রকল্পে মার্ডার হলেও কারো কথা বলার অধিকার নাই।পুরো উপজেলায় মুজিব বর্ষের আশ্রয়ন প্রকল্পের নামে প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ এক হয়ে দূর্ণীতি আর দখলবাজী চালিয়েছে।

উপজেলার একটি সুত্রে জানাযায়, শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পরে, মুজিব বর্ষের নামে বরাদ্দকৃত লুটপাটের সকল প্রকল্প ফেরত দিয়েছে দেশের সব ডিসি ইউএনও। তবে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন, সাবেক বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সির আস্থাভাজন ও অতিমাত্রায় আওয়ামী প্রেমী হওয়ায় ৫ আগষ্টের পরে কৌশলে শেখ হাসিনার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন।

ফসলি জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন,  অবৈধ ড্রেজার ব্যবহার, মাটি বিক্রির প্রশ্নে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (PIC) সদস্য, উপজেলা প্রকৌশলী (অ:দা:) মো: আসাদুজ্জামান জেমি বলেন, জমি নির্বাচনের বিষয়টি আমার নয় এটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। আমার কাজ শুধুই স্থাপনা দেখা কাজ ঠিক হচ্ছে কিনা। ঘর নির্মাণের অনিয়মের বিষয় জানতে চাইলে, তিনি বলেন শল্লার বিল আমার আমলে হয়নি এব্যাপারে আমার কোন মন্তব্য নেই।

এবিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সাবেক আব্দুল আজিজ ও  বর্তমান আলতাফ হোসেন অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, প্রকল্পের সভাপতি ও আয়ন ব্যায়ন কর্মকর্তা ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সকল প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিতে পারবেন।

আইন অমান্য করে ফসলি জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প করার কারণ জানতে চাইলে, ইউএনও নাজমুল হক সুমন বলেন, যা করা হয়েছে তা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে বে-আইনীভাবে ড্রেজার মেশিন ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ড্রেজার দিয়ে শুধু মাত্র ফিনিশিং করা হয়েছে। নাগরিক সুবিধার বিষয় তিনি বলেন, বরাদ্দ সাপেক্ষে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা হবে।তিনি আরও বলেন আমি বিএনপি জামায়াতের লোকদের সাথে নিয়ে কাজ করেছি। এছাড়া অন্য প্রশ্নের উত্তরে ব্যস্ততা দেখিয়ে এরিয়ে যান তিনি।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রকল্প জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর বাস্তবায়ন নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি। মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান ও বন্যায় ডুবে যাওয়ার বিষয়ে বলেন, প্রকৌশলী দিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাব না দিয়ে বলেন, আমি ব্যস্ত আছি পরে কথা হবে। পরে আর তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

 

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিস্তারিত জানতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Advertisement

Contact with your
Creative & Technology Partner

Advertisement